অযত্ন-অবহেলায় ফোয়ারা ও চত্বর : রক্ষণাবেক্ষণে বাজেট নেই!
মামুন পারভেজ :
মামুন পারভেজ : ইতিহাস ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত সিলেট নগরীর সৌন্দর্য্যবর্ধনে তৈরি ফোয়ারা, চত্বরসহ স্থাপনা রক্ষায় সিসিকের কোনো বাজেট নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর সৌন্দর্য্যবর্ধনে তৈরি এসব স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরাসরি কোনো বাজেট নেই অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সংস্কার কাজ হয় সেই অযুহাতে হাতপা গুটিয়ে বসে আছে সিসিক। বাজেটে নির্ধারিত অর্থ প্রাপ্তি হয়নি তাই সংস্কার কাজে হাত দিতে পারছে না জানালেন সিসিক প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর। সংস্কারের বাজেট নেই অথচ প্রতিবছরই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে একেরপর এক স্থাপনা। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অর্থ না থাকলে কেনো এই কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে প্রশ্ন সচেতন মহলের।
সম্প্রতি সিলেট নগরীর কোর্টপয়েন্টে, সুবহানীঘাট ও মেন্দিবাগ পয়েন্টে দৃষ্টি নন্দন চত্বর নিমার্ণ করা হয়েছে। এছাড়া, আল্লাহর ৯৯ নাম নিয়ে আরো একটি চত্বর নগরীর চৌহাট্টায় নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান প্রকৌশলী। কোটি টাকারও বেশী ব্যয়ে নির্মিত নগরীর ৬টি ফোয়ারার ৫টিই এখন অচল। এসব ফোয়ারার অবস্থান হলো- শাহী ঈদগাহের ভেতরে পুকুরের ফোয়ারা, শাহী ঈদগাহের দক্ষিণ পাশের মোড়ে, কুমারপাড়া পয়েন্টে, নইওরপুল পয়েন্ট ও সুরমার তীরে সার্কিট হাউসের সামানের ফোয়ার।
জোট সরকারের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের উদ্যোগে সিলেট নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হয় ছয়টি ফোয়ারা। ফোয়রাগুলো দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে অচল পড়ে আছে। ২০১২ সালে ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামত করা হলেও তা মাস খানেকের মধ্যে আবার অচল হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ার কারণে নগরীর ফোয়ারাগুলো একধরণের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ফোয়ারার গর্তে জমেছে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। অযত্নে আর অবহেলায় চুরি হয়ে গিয়েছে ফোয়ারার রঙিন বাতিসহ সরঞ্জামাদি।
এব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন জানায়- ফোয়ারাগুলোর রঙিনবাতি, এমনকি ডিভাইডারের এসএস পাইপগুলো পর্যন্ত চুরি হয়ে যায়। নির্মাণের পর কয়েক মাস ফোয়ারাগুলো সচল ছিল। ফোয়ারাগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য ছয়জন প্রহরী ছিলেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তাঁদের বেতন দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী সিলেট আসেন। সিলেটের প্রবেশদ্বারেই ঐতিহ্যের স্মারক ক্বিনব্রীজ ও আলী আমজাদের ঘড়িঘর, সারদা হলের মত স্থাপনা দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। শতবর্ষী ক্বিনব্রীজ ভাসমান ব্যবসায়ীদের দখলে, আর সিসিকের পরিবহন সেবা নগর এক্সপ্রেসের বাস, কনজারভেন্সি বিভাগের ট্রাক এছাড়া উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত বড় বুলডোজার, ট্র্যাঙ্ক লড়ির আড়ালে পড়ে থাকছে আলী আমজাদের ঘড়িঘরের মত ঐতিহাসিক স্থাপনা। রাত ৮টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত নগর এক্সপ্রেসের দখলে থাকে সুরমাপাড় এলাকা। নগর এক্সপ্রেস রাস্তায় নামার সাথে সাথে শূণ্যস্থানপূরণ করে কালিঘাটে আসা পণ্যবাহী ট্রাক পিকআপ।
এছাড়া, ছোট খাটো ভ্যান রিক্সাও আশ্রয় নেয় এসব বড় গাড়ির ফাঁকে। গাড়ির আড়ালে চলে মাদক সেবনসহ অনৈতিক কার্যকলাপ। দর্শনার্থীরা এসে যে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে সময় কাটাবেন, দুই একটা ছবি তুলবেন তার কোনো জো নেই। এনিয়ে আগত দর্শনার্থীদের প্রায়শই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। সিটি কর্পোরেশন বলছে- তাদের গাড়ি পার্কিয়ের কোনো জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে গাড়িগুলো সুরমাপাড়েই পার্ক করতে হচ্ছে। এদিকে, ঐতিহ্যবাহী সারদা হলের একটি অংশে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের অফিস ও মূল হলটি গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিলেট জেলার পর্যটন স্পটগুলো খুব কাছাকাছি হওয়ায় আগত দর্শনার্থীর বেশির ভাগই সিলেট নগরে অবস্থান করেন। পর্যটন স্পটগুলো দেখার পাশাপশি তারা নগরীর দৃষ্টনন্দন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখেন। ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে এসে নগর কর্তৃপক্ষের রাখা যানবাহন দেখে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয় তাদের।
এদিকে, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ইচ্ছায় জি টু জি প্রকল্পের আওতায় কোর্ট পয়েন্টে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালে নির্মিত হয়েছিল সিলেট নগরীর প্রথম ফুট ওভারব্রিজ। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এটির উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী নিজে। যানজট হ্রাস ও পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার্থে ব্রীজটি নির্মাণ করা হলেও পথচারীরা শুরু থেকেই ব্রীজটি ব্যবহার করেন নি। শখের বসে ব্রীজটিতে উঠতে দেখা যায় আগত দর্শনার্থীদের। বর্তমানে ব্রীজটি ভাসমান মাদকসেবিদের আশ্রয়স্থল হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- নোংরা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে ফুট ওভারব্রীজটি। জায়গায় জায়গায় ময়লার স্তুপ এমনকি মলমূত্র রয়েছে ব্রীজটির উপর। যার কারণে যারা শখের বসে ব্রীজটিতে উঠেতেন তারাও এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
এছাড়া, সিলেট নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধনে বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরি করা হয়েছে চত্বর। যেগুলোর বেশিরভাগই রক্ষণাবেক্ষণে সিসিকের উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। দক্ষিণ সুরমায় হুমায়ুন রশীদ চত্বর, নগরীর প্রবেশদ্বারে সুরমা পয়েন্টে নাগরী চত্বর, কোর্ট পয়েন্টে নগর চত্বর (জনতার কামরান চত্বর), রিকাবী বাজারে কবি নজরুল চত্বর, সাগরদীঘিরপাড় পয়েন্টে বর্ণমালা চত্বর, হাওয়াপাড়া শহীদ চত্বর, নয়াসড়কে মাদানী চত্বর, কুমারপাড়া চত্বর, শাহী ঈদগাহের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে আল্লাহু চত্বর উল্লেখযোগ্য। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে চত্বরগুলো নিমার্ণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশির ভাগ চত্বর এখন আর দৃষ্টিনন্দন নেই।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নাকের ডগায় নাগরী ও নগর চত্বর। সরকারি ও বেসরকারি পোস্টারে ছেয়ে ফেলা হয় বিভিন্ন সময়ে। এছাড়া, রাত্রি নামার সাথে সাথে ভাসমান মাদকসেবিদের আশ্রয়স্থলে পরিনত হয় এসব চত্বর। প্রায়শই তাদের অবাধে নেশা সেবন করতে দেখা যায়।
এছাড়া, রিকাবী বাজারের নজরুল চত্বরের দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল, নগরীর হাওয়াপাড়ার শহীদ চত্বরটির জরাজীর্ণ অবস্থা। ঈদগাহর দক্ষিণ চত্বর এখন ভাঙা স্তুপ। ধোয়ামোছার কোনো বালাই নেই, সন্ধ্যা নামলে চত্বরগুলোতে রঙিন বাতি জ্বালানোর কথা থাকলেও অন্ধকারই বিরাজ করছে সবসময়। কোথাও কোথাও সড়ক বাতির আলোয় নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে চত্বরগুলো।
পর্যটন নগরীর খ্যাত সিলেট নগরীর পর্যটন খাতে অবহেলা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে জড়িতরা। সিলেট ট্যুরিজম ক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন- ইতিহাস ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর আমাদের সিলেট। পর্যটন নগরী সিলেটের নগর পর্যটন খাতে সিটি কর্পোরেশনের কোনো বাজেট নেই। গত দুইবারের সিসিকের বাজেটে আমরা তাই লক্ষ্য করেছি। তাই অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে ঐতিহাসিক স্থাপনাসহ সম্ভাবনাময় পযর্টন ক্ষেত্র। এমনকি, রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধনে তৈরি করা স্থাপনাগুলো।
সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এটিএম শোয়েব গণমাধ্যমকে বলেন- ক্বিনব্রীজ, আলী আমজাদের ঘড়িঘর, শারদাহলসহ সিলেটকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন সব স্থাপনা পরিচ্ছন্ন করে রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন ও প্রশাসনের। নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধনে স্থাপনাগুলো অবশ্যই সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তাদের কথামত ব্যয় যদি বেশি হয়, তাহলে নষ্ট ফোয়ারাগুলো সংস্কার করে প্রয়োজনে তা বন্ধ করে রাখা হউক, বিভিন্ন দিবসে তা ছেড়ে দিতে পারেন। আগত দর্শনার্থীদের হতাশ করা যাবে না।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন- সৌন্দর্য্য বধর্নে নির্মিত স্থাপনাগুলো পুনসংস্কার করতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। সিলেটের নগর পর্যটন বাজেট আসলে অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে করা হয়। স্থাপনা সংস্কার সংরক্ষণ কাজের ব্যয় সিসিক রাজস্ব আয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে করা হয়ে থাকে। কিন্তু টার্গেটের ২০ শতাংশও আদায় হয়নি। এ মুহূর্তে অর্থ সংকুলান না হওয়ায় আামরা এ কাজে হাত দিতে পারছি না। সুরমাপাড় ও আলী আমজাদের ঘড়ি ঘরের পাশে সিসিকের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমাদের নির্ধারিত পাকিংয়ের জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে সুরমাপাড়ে পার্কিং করতে হচ্ছে।