অভিভাবকহীন সিলেট ছাত্রলীগ : ভিড় বাড়ছে বলয়ে
স্টাফ রিপোর্টার :
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রাচীনতম এ সংগঠনের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিলো গতকাল সোমবার (৪ জানুয়ারি)। দীর্ঘ সময় পথচলায় প্রাচীনতম এ সংগঠনের অর্জন, প্রাপ্তি আছে। আছে দুর্নামও। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এ সংগঠনের অতীত ইতিহাস গৌরবের হলেও বর্তমানটা বেশ মলিন। কমিটি নিয়ে বাণিজ্য, ‘ভাইলীগের’ বিস্তার, নানা অপকর্ম কিংবা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়া নেতাকর্মীর কারণে বারবার হোঁচট খাচ্ছে ছাত্রলীগ। ব্যতিক্রম নয় সিলেটেও।
দীর্ঘদিন ধরে কমিটি নেই সিলেট জেলা ও মহানগরে। অথচ এখানেও কম নেই ছাত্রলীগের প্রভাব, প্রতিপত্তি কিংবা সমালোচনা। খুন, নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন সিলেট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। যদিও কেন্দ্র সবসময় কমিটিবিহীন এসব নেতাদের অস্বীকার করে আসছে।
এদিকে, দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় বলয়ভিত্তিক ছাত্রলীগের প্রভাব বাড়ছে। আর নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করতে অছাত্র, ছাত্রদল আর শিবিরের নেতাকর্মীদের দলে টানছেন কেউ কেউ। বাদ পড়ছেন না অবিবাহিত কিংবা চিহ্নিত চাঁদাবাজরাও। সিলেটে ‘সব ছাত্রলীগের ভিড়ে’ আসল ছাত্রলীগ খোঁজে পাওয়া দুষ্কর।
জানা যায়, ২০১৭ সালের অক্টোবরে সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে সিলেট জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। একই অভিযোগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে সিলেট মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর কেটে গেছে পাঁচটি বছর। বারবার কেন্দ্র থেকে আশ্বাস আর কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্ত নিলেও পাঁচ বছরে কমিটির মুখ দেখেনি সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগ। জেলায় তিন বছর আর মহানগরে দুই বছর ধরে কমিটি নেই। দীর্ঘ সময়ে কমিটি না হওয়ায় অনেকেই ছাত্রলীগ ছেড়ে অন্য সংগঠনে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। এতে সিলেটে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে। বলা চলে সিলেটে অনেকটা নিষ্প্রাণ ছাত্রলীগ। ফলে দলের কর্মী সমর্থকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাই নতুন বছরে কমিটি গঠনের জোর দাবি জানিয়েছে ছাত্রলীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা।
এদিকে কমিটি না থাকায় একদিকে যেমন নতুন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, অন্যদিকে নামে-বেনামে সাবেক ছাত্রনেতাদের ছত্রছায়ায় একাধিক গ্রুপ-উপগ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং খুনোখুনির মতো ঘটনাও ঘটছে। কমিটি না থাকায় এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে দায় এড়িয়ে চলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
২০১৭ সালের অক্টোবরে নগরীর টিলাগড়ে দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ হারাণ মিয়াদ নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী। এরপরই তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এরপর পদ-প্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবন বৃত্তান্ত জমা নেয়া হলেও কমিটি দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী। এরপর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিটের কমিটি গঠন করা হয়নি। দীর্ঘদিন থেকে কমিটি নেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পলিটেকনিক্যাল কলেজে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কমিটিবিহীন অবস্থায় থাকায় বেশিরভাগ ক্যাম্পাসে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুসারীরা আধিপত্য বিস্তার করে সংগঠনটির কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। সাবেক এই ছাত্রনেতাদের রয়েছে নিজস্ব বলয়, গ্রুপ-উপগ্রুপ। অভিযোগ রয়েছে ক্যাম্পাসে নিজেদের বলয় ভারি এবং শক্তি প্রদর্শন করতে ছাত্রদল-শিবির, অছাত্র ও মামলার আসামিদের দলে ভেড়াচ্ছেন। ফলে ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে চলছে আধিপত্য। মারামারি ও খুনোখুনির মতো ঘটনা ঘটছে। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন- ছাত্রলীগ আমাদের সহযোগী সংগঠন। সাংগঠনিকভাবে তারা স্বাবলম্বী এবং তাদের নিজস্ব একটি স্বক্রীয়তা রয়েছে। সুতরাং আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি আশা করি তারা একটি ভালো কমিটি উপহার দেবেন।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান বলেন- ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতাদের বারবার কমিটি গঠনের কথা বললেও তারা এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেন নি। ছাত্রলীগের এই অবস্থাকে নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের সংকট বলে মনে করেন তিনি।
কমিটি গঠন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী বলেন- বিগত কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ নিয়ে আলাপ হয়েছে। একইসঙ্গে বিভাগীয় দায়িত্ব বণ্টনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করি দ্রুতই সিলেটের দুটি ইউনিটে কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু হবে।