সুরমা ও ধনু নদীর বাঁকে বাঁকে মাছ নয়, মানুষ মারার ফাঁদ!
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, হাওরাঞ্চল (সুনামগঞ্জ) ঘুরে : সুনামগঞ্জের সুরমা ও ধনু নদীর বাঁকে বাঁকে দুই পাড়ে মাছ শিকারের জন্য গাছের ডাল-বাঁশ পুঁতে বছরের পর বছর মাছ ধরার ঘের তৈরী করে প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদী দখল করে নিয়েছে নদীতীরের কিছু প্রভাবশালী। মাছ আটকানোর নামে এই পদ্ধতিগুলো মানুষ মারার ফাঁদে পরিণত হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
দখলকৃত ঘেরগুলোর কারণে সুরমা-ধনু নদী দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে লঞ্চ, কার্গো, যাত্রবাহী নৌযান প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। গত কয়েক বছরে অসংখ্য লঞ্চ ও নৌদুর্ঘটনার মধ্যে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জেলার জামালগঞ্জ অংশের আলীপুর নদীর বাঁকে বাঁশের এই ঘেরের কারণে পাথরবাহী ভলগেট নৌকার সাথে ধাক্কা লেগে যাত্রী ভর্তি ট্রলার ডুবে ৪৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়াও প্রতি বছরই ঘেরের সাথে ছোট-খাটো নৌ-দুর্ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুরমা-ধনু নদীর দুই পাড়ে এভাবে ‘বাঁশ-কাটা’ স্থাপনের কারণে শত শত পেশাজীবী জেলে উন্মুক্ত নদীতে মাছ ধরতে না পারায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। কোন কোন স্থানে নদীতে বেশী বাঁশ পুঁতে রাখার কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পলি জমে নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধগুলো উপচে হাওরাঞ্চলের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার কারণের একটি হচ্ছে এটি। সুনামগঞ্জ-ভৈরব নদী পথে কারগো, লঞ্চ, বাল্কহেড, যাত্রীবাহি ট্রলার চলাচলেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে।
হাওরে বেশ কয়েক দিন ঘুরে এই নদী পথে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার লালপুর, লক্ষ্মীপুর, রামপুর, জামলাবাজ, গজারিয়া, কামধরপুর, আলীপুর, আমানীপুর ও বিষ্ণুপুর এবং ধর্মপাশা উপজেলার গোলকপুর, বাবুপুর, চাদরা, শয়তানখালী ও সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার মিলন স্থলে খালিয়াজুরী উপজেলার নাউটানা, জগন্নাথপুর, আসাদপুর, রাজীবপুর, লিপ্সাবাজার, শিবির, শালদিঘা, হারাকান্দি, পাথরা ও মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর বাজার, মান্দারবাড়ী, গাগলাজুর নতুন বাজার সীমানা এলাকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদী পথের এমন চিত্র দেখা দেখা গেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ- বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) যথাযথ তদারকি না থাকায় এই নদী পথে অবৈধ দখলদারিত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারা জানান- মাছ শিকারের জন্য উন্মুক্ত নদীটি দখল করে ‘মাছ ধরার ঘের’ তৈরী করতে নদীতীরবর্তী এলাকার প্রভাবশালী মহল বর্ষার শুরু থেকেই গাছের ডাল ও বাঁশ-কাঁটা সংগ্রহ করে রাখে। বর্ষার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ওই সব ডাল নদীতে ফেলে অধিকাংশ নদী জুড়ে বাঁশের খুঁটি পুতে ঘেরাও করে দখলে রাখে নদীর কিছু সীমানা।
জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের অনিল বর্মণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- ‘ও সাংবাদিক ভাই, লেইখ্যা কি লাভ’ কাম অইবনি। আমরা জালুয়ারার (জেলে) কথা লেইখ্যা কিতা অইব! গাং তো (নদী) ধনী লোকরার দহলেই অছে।’ হরি দাস বর্মণ বলেন- ‘আমরার পূর্ব পুরুষরার পেশা ছাইড়া অন্যের বাড়িতে কামলা দিয়া কোনো রহমে সংসার চালাইতাছি।’ যারার টেকা-পয়সা আর লাটি শক্তি আছে হেরাই অহন জালুয়ারার (জেলে) নাম ধইরা গাং (নদী) বড় বড় বিল (লজমহাল) দখল কইরা রাখছে। একই মন্তব্য করেন আমানীপুর গ্রামের জেলে জয় মোহন বর্মণ, সমের বর্মণ, রানা বর্মণসহ অনেকেই।
গজারিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী কৃষক আলী বলেন- ‘১৫-২০ বছর আগেও এই সুরমা ও ধনু নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার, কার্গো, যাত্রীবাহি নৌযান চলত। খননের অভাবে এমনিতেই নদী ভরাট হইয়া গেছে। আর এহন, মাছ ধরার লাগি প্রভাবশালীরা গাছের ডাল ফালাইয়া বাঁশ-কাঁটা দিয়া নদীডারে আরো ধ্বংস কইরা দিতাছে। মালবোঝাই বড় নৌকাও ঠিকমতো চলতে পারতেছে না।’
এই নৌপথে চলাচলকারী ‘এমভি লাল সাহেব’ লঞ্চের এক কর্মচারী বলেন- ‘নদীটি খননের অভাবে এমনিতেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার এলাকার প্রভাবশালীরা নদীর দুই পারে বাঁকে-বাঁকে বিশাল জায়গাজুড়ে কাটা দিয়ে নদীটিকে আরো সরু করে ফেলেছে। এতে এই নৌপথে লঞ্চ-কার্গো চালাতে আমরা বাধার মুখে পড়ি। রাতের বেলা অনেক সময় দিক নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়।’ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করাসহ নদীটি দ্রুত খনন করার দাবি জানান তিনি।
‘এমভি ড্রিম অব মশিউর’ কার্গোর মালিক মাহাবুবুল আলম বলেন- নদী থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদসহ নদীটি দ্রুত খনন করা না হলে দু-তিন বছরের মধ্যেই এ নৌপথে মালবাহী কার্গোসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।