সংক্রমণে অস্থির সিলেট : নেই আইসিইউ বেড : সিটের বিপরীতে রোগী তিনগুন
বিশেষ সংবাদদাতা :
শাহিদ হাতিমী : করোনা সংক্রমণে অস্থির সিলেট। প্রতিদিন সংক্রমন এবং মৃত্যুর হার ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিগত রেকর্ড। তার উপর করোনা রোগীদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় আইসিইউ বেড নেই সিলেটে। এ অবস্থায় সিলেট অঞ্চলের মানুষ উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত। মঙ্গলবার (৬ জুলাই) সিলেটের তিনটি ল্যাবে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন মোট ২৬৭ জন। এর মধ্যে শাবির পিসিআর ল্যাবে ১০৭ জন এবং ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে শনাক্ত হয়েছেন ১২০ জন এবং বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শনাক্ত হয়েছেন ৩৯ জন।
২০২০ সালের ৫ এপ্রিল সিলেটে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরের মে-জুনে শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তবে আগস্টের পর কমতে থাকে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সংক্রমণ ছিল নিয়ন্ত্রণে। তবে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আবারও বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এপ্রিলে বাড়ে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। মে মাসের প্রথম থেকে আবার শনাক্ত কমতে থাকলেও গত ঈদের পর তা বাড়তে শুরু করে। জুনের শেষ দিকে বাড়তে শুরু করে আশঙ্কাজনক হারে। এতে করে বিভাগের চার জেলাকেই অতি উচ্চ সংক্রমিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন- কোনো এলাকার সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি হলে তাকে উচ্চ সংক্রমিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেখানে সিলেট বিভাগে শনাক্তের হার তিনগুণের বেশি। ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ায় সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা।
বিগত বছরের এপ্রিলের শুরুতে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব মেলে। শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশে প্রতিদিনই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হার বাড়ছে। দেশে করোনা আক্রান্তদের নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মে মাসে ৪৫ শতাংশ ও জুন মাসে ৭৮ শতাংশ পাওয়া যায়। বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এই প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া গেলে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতো। তারা বলছেন- শুরু থেকেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) কম ছিল। মহামারিকালে এর সংখ্যা যেভাবে বাড়ার কথা, সেভাবে বাড়েনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে- দেশে করোনা আক্রান্তদের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড রয়েছে এক হাজার ১৯৫টি। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ৩৮৪টি।
সিলেট বিভাগে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের করোনাভাইরাস পরীক্ষার গবেষণাগারটি চালু হয় ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে। সিলেট বিভাগের সাতটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও আইসিইউ রয়েছে মাত্র দু’টি হাসপাতালে। এর একটি হচ্ছে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ সদর হাসপাতাল।
সোমবার (৫ জুলাই) সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়- হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১০০ শয্যা (সিট-বেড) রয়েছে, তার মধ্যে ৯৮টিতে রোগী ভর্তি। আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৬টি, তার মধ্যে দুটি আইসিইউ বরাদ্দ রয়েছে ডায়ালাইসিস রোগীদের জন্য। ১৬টির মধ্যে বর্তমানে ১৫টি আইসিইউতে রোগী রয়েছেন। কিন্তু ৬ জুলাই (মঙ্গলবার) হাসপতাল পর্যবেক্ষণ করে জানা যায় আইসিইউ শয্যা তো দূরের কথা সাধারণ সিট-বেডও খালি নেই। অনেকেই নিরুপায় হয়ে ফ্লুরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আর হাসপাতালে সিট-বেড সেবা পর্যাপ্ত না হলে অচিরেই ভয়ংকর অবস্থা হবে সিলেটের। মরণঘাতি করোনায় ভয়ংকর হয়ে ওঠবে সিলেট।
এদিকে, অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেটে মৃত্যুহার ও সংক্রমণ অনেকটাই কম বলে জানিয়েছেন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালটির চিকিৎসকরা। সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান- অন্যান্য জায়গার তুলনায় আমাদের এখানে মৃত্যুহার ও সংক্রমণ অনেকাংশেই কম। সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুহার অনেক কম। তবে, আমাদের এখানে যে আইসিইউ রয়েছে সেগুলো পর্যাপ্ত না। আবার পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ রয়েছে।
সিলেট বিভাগে গত ২১ জুন থেকে ২৭ জুন এক সপ্তাহে করোনা শনাক্ত হয় ৮১৩ জনের। আর গত ২৮ জুন থেকে গতকাল ৪ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত শনাক্ত হন এক হাজার ৬৮৬ জন। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্ত বেড়েছে ৮৭৩ জন।
এদিকে, গত এক সপ্তাহে (২১ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত) নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪ হাজার ৩৭৫টি। আর চলতি সপ্তাহে (২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত) নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫ হাজার ২৯০টি। এক সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে ৯১৫টি। গত সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর চলতি সপ্তাহে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত হয়েছে ৩১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এক সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। তবে পরীক্ষা, শনাক্ত, শনাক্তের হার বাড়লেও কমেছে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। গত সপ্তাহে ২১ জনের মৃত্যু হলেও চলতি সপ্তাহে করোনা শনাক্ত হয়ে মারা গেছেন ১৬ জন।
চলতি সপ্তাহে সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে সিলেট জেলায়। চলতি সপ্তাহে এই জেলায় শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ১৩৩ জন। এছাড়া সুনামগঞ্জে ১১৩ জন, হবিগঞ্জে ১৯৭ জন এবং লভীবাজারে ২৪৩ জন শনাক্ত হয়েছেন। সংক্রমণ রোধে সিলেটসহ সারাদেশে চলছে কঠোর বিধি-নিষেধ। বিধি-নিষেধ কার্যকরে সিলেটে শক্ত অবস্থানে রয়েছে র্যাব-পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসন। অকারণে বের হওয়াদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরে। এছাড়া যারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না ও বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন- ‘লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সংক্রমণের লাগাম কিছুটা টেনে ধরা যাবে। এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মেনে চলতে হবে সরকারি বিধিনিষেধ।