হবিগঞ্জে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনে হরিলুট : ল্যাব দু’টিতে নতুন কম্পিউটার প্রদানের চিঠি
হবিগঞ্জ সংবাদদাতা
হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকরামুল মজিদ চৌধুরী শাকিলের ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের নামে জালিয়াতির অভিযোগের দীর্ঘ তদন্ত শেষে দুইটি ল্যাবে নতুন কম্পিউটার প্রদানের জন্য চিঠি দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং। লাখাই উপজেলার এলজিইডির প্রকৌশলী মো. শাহ আলমের মাধ্যমে এ নির্দেশ প্রদান করা হয়। উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এ সম্পর্কিত কোন চিঠি পাননি বলে জানান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সত্ত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার মনসুর রশিদ কাজল।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়- বিদ্যালয় দু’টিতে স্থাপিত ডিজিটাল ল্যাবে ৪৮টি কম্পিউটারের মধ্যে ৪৩টি ২০১৪ সালে ও ৫টি ২০১৫ সালের আমদানী করা। যার মধ্যে ৪৩টির মেয়াদ ২০১৭ সালে ও ৫টির মেয়াদ ২০১৮ সালে শেষ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কম্পিউটার বাদ দিয়ে ওয়ারেন্টি হালনাগাদ’সহ ভাল কম্পিউটার দিতেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
গত ১০ ও ১১ মার্চ লাখাই উপজেলার দু’টি বিদ্যালয়ের ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের নামে হরিলুট সংবাদ প্রকাশ হলে টনক নড়ে স্থানীয় প্রশাসনের। এরই প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। পরে উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের নির্দেশে ঢাকা থেকে দু’জন বিশেষজ্ঞ টিম যুক্ত করা হয়। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাবার পর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি চিঠি প্রদান করেন।
এ ব্যাপারে লাখাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন- গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি নির্দেশ অনুযায়ী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু উপজেলা পরিচালনা ও উন্নয়ন প্রকল্পের ঢাকার নির্দেশে দু’জন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এসে আবার তদন্ত করেন। গত ২৪ জুন তাদের প্রতিবেদন হাতে পাই। তাদের সুপারিশ যাচাই-বাচাই করে উপজেলা প্রকৌশলীকে ১৯ জুলাই চিঠি দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেবার জন্য।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বলেন- ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কে বি কনস্ট্রাকশকে ৩/৪ দিন পূর্বে মেইন ও ডাকযোগে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সত্ত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার মনসুর রশিদ কাজল জানান- এ সম্পর্কিত কোন চিঠি তিনি পাননি। বলেন- এ কাজ সর্ম্পকে তিনি ভাল করে কিছুই জানেন না। এর কারণ হিসেবে বলেন- ‘আমার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে করা হলেও কাজটি করেছেন লাখাই উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাকিল চৌধুরী।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ৩০ এপ্রিল জাইকা’র অর্থায়নে পরিচালিত উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের কর্মসূচীতে লাখাই উপজেলার দু’টি উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কম্পিউটার, টেবিল ও চেয়ার দিয়ে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিক্যাল সামগ্রী প্রদান এবং ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে করাব ইউনিয়নে বড় গোপাটের খাল থেকে আজদার মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত আরসিসি উন্মুক্ত ড্রেন নির্মাণ এর দরপত্র আহবান করে এলজিইডি।
এক প্রভাবশালী নেতার আর্শীবাদে এ তিনটি কাজেরই ঠিকাদার নিযুক্ত হন ইকরামুল মজিদ চৌধুরী শাকিল। দরপত্র অনুসারে গত অক্টোবরে উপজেলার রাঢ়িশাল করাব উচ্চ বিদ্যালয় ও তেঘরিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করেন। দরপত্র অনুযায়ী ‘ডেল কোম্পানীর অপটিপ্লেক্স-৩০২০, কোরআই-৩ মডেলের’ ৪৮টি কম্পিউটার সরবরাহ করেন দুই বিদ্যালয়ে ঠিকাদার শাকিল চৌধুরী। সরবরাহের কয়েকদিন পর তেঘরিয়া এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৪টি ও রাঢ়িশাল করাব উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫টি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়।
ঠিকদারী প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত সবক’টি কম্পিউটার বিশ্বখ্যাত ব্রা-ডেল কোম্পানীর। কিন্তু সবগুলো কম্পিউটার কমপক্ষে ৪ বছর পূর্বে আমদানী বন্ধ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের আমদানীকারকরা। এমনটাই জানা গেছে- ষ্টার টেক ও গ্লোবাল ব্যান্ড নামের দু’টি আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ করে।
তাছাড়া ডেল’র ওয়েবসাইটে গিয়ে সরবরাহকৃত কম্পিউটারগুলোর মধ্যে 2FQJ102, 2VPJ102 ও 3Z8K102 সার্ভিস ট্যাগ যাচাই করে করে দেখা যায়- এগুলো ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আমদানী করা হয় আর বিক্রয় করা হয় ২০১৬ সালে। সার্ভিস ওয়ারেন্টি মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত।
এদিকে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত কম্পিউটার ক্রয়ের রশিদ থেকে জানা যায়- শাকিল চৌধুরী ‘রিয়েল ওয়ান’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার ক্রয় করেন। রশিদে প্রতিষ্ঠানের যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে বাস্তবে এমন কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে তাদের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে শিহাব আহমেদ নামে এক ব্যক্তি ফোন রিসিভ করেন।
শিহাব আহমেদ জানান- তিনি মূলত কম্পিউটার সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন। তবে কম্পিউটার সাপ্লাইয়ের অর্ডার পেলে তিনি ঢাকার বিভিন্ন দোকান থেকে সংগ্রহ করে দেন। তিনি আরও জানান- বিক্রয়গত কম্পিউটারের নিজে ১ বছরের ওয়ারেন্টি দেন। আবার নষ্ট হয়ে গেলে তিনি নিজে ঠিক করে দেন।