সিলেটের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত: পানিবন্দি হাজারো মানুষ, নৌকাডুবিতে নিখোঁজ
স্টাফ রিপোর্টার
টানা বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে সিলেটের সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। গোয়াইনঘাটে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ, জেলা ও উপজেলা সদরের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কয়েকটি গ্রাম। জৈন্তাপুরে পানির নিচে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় নৌকাডুবে নিখোঁজ হয়েছেন এক পাথর শ্রমিক।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়— সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা’সহ সারি এবং পিয়াইন নদীর পানি বেড়েই চলেছে। কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়ে পড়েছে গোয়ানাইঘাট, জৈন্তাপুর ছাড়াও কোম্পানীগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য মতে— সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট উপজেলা দিয়ে ইতোমধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করছে। শুক্রবার ভোর ৬টায় থেকে ওই অঞ্চলে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ০.৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট এলাকার ডেঞ্জার লেভেল ১২.৭৫ সেন্টিমিটার। এ পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৬টায় ছিল ১৩.৩৪ সেন্টিমিটার। সিলেটে সুরমার ডেঞ্জার লেভেল ১০.৮০ সেন্টিমিটার। সকাল ৬টায় এই নদীর পানি ছিল ৯.৫২ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদী শেওলা এলাকার ডেঞ্জার লেভেল ১৩.০৫ সেন্টিমিটার। সকাল ৬টায় এই নদীর পানি ছিল ১০.৮৬ সেন্টিমিটার। সারি নদী গোয়াইঘাটের ডেঞ্জার লেভেল ১২.৩৫ সেন্টিমিটার। সকাল ৬টায় এই নদীর পানি ছিল ১১.৯৫ সেন্টিমিটার। সুনামগঞ্জ সুরমার ডেঞ্জার লেভেল ৭.৮০ সেন্টিমিটার। সকাল ৬টায় এই নদীর পানি ছিল ৬.৩২ সেন্টিমিটার।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে— সিলেটে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৬৮.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন— আগামী ১৮ তারিখ পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ে দিনের চেয়ে রাতে বেশি বৃষ্টিপাত হবে।
জৈন্তাপুর থেকে সংবাদদাতা জানান— জৈন্তাপুরে ভারী বর্ষণে নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নৌকাডুবে এক পাথর শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। শিশুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উদ্ধার করা হয়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। বিভিন্ন গ্রামের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নিজপাট এবং জৈন্তাপুর ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ এখন পানিবন্দি। বেশিরভাগ রাস্তা পানির নিচে থাকায় বিভিন্ন গ্রাম’সহ উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদনদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ঘটে গেলো নৌকাডুবির ঘটনা। শুক্রবার সকাল ১০টায় উপজেলার ২নং জৈন্তাপুর ইউনিয়নের মুক্তাপুর গ্রামের পাথর শ্রমিক আলমগীর হোসেন দুই শিশু ছেলে ও এক ভাতিজাকে একটি ছোট নৌকায় করে পার্শ্ববর্তী বাড়ি যাচ্ছিলেন। এমন সময় বড়গাং নদীর বুদাইরভাঙা নামক স্থানে প্রবল স্রোতে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায় এবং শিশুগুলোকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও দ্রুতগতির পানির স্রোতে আলমগীর হোসেন (৩২) কে সবার আড়াল করে দেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের লোকজন এবং উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল দিনভর উদ্ধার তৎপরতা চালায়। কিন্তু বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকা ব্যাপক তল্লাশি করেও আলমগীর হোসেনের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ আলমগীর হোসেনের মরদেহ উদ্ধার তৎপরতা দেখতে নৌকাযোগে ঘটনাস্থলে ছুটে যান জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন, জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম, জৈন্তাপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ গোলাম দস্তগীর আহমদ, জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম, দরবস্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাহারুল আলম বাহার। এসময় তারা নিখোঁজ আলমগীরের বাড়ীতে যান এবং পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
গোয়াইনঘাট থেকে সংবাদকর্মী জানান— গোয়াইনঘাটে আবারও আকষ্মিক পাহাড়ি ঢলে জেলা উপজেলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। পানিতে ভাসছে ধানের মুঠি। কৃষক পরিবারে চলছে আর্তনাদ।
গোয়াইনঘাটে গত মার্চ এপ্রিলের শেযে পরপর আকষ্মিক পাহাড়ী ঢলের আঘাতের পর শুক্রবার সকালে তৃতীয় দফা ঢলের আঘাতে গোয়াইনঘাটের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাঠে কাটা ধানের স্তুপ স্রোতে ভেসে নিচ্ছে। উপজেলায় প্রায় ৫০ ভাগ ফসল কাটার বাকী ছিল। গত ৪দিন ধরে বৃষ্টি থাকায় মাড়াইকৃত ধান কৃষকের ঘরে নষ্ট হচ্ছে। গোয়াইন-সারি গোয়াইনঘাট-সালুটিকর রাস্তা কয়েক স্থানে নিমজ্জিত থাকায় জেলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পিরিজপুর সোনারহাট রাস্তার উনাই হাওরে এলজিইডির ব্রীজ নির্মাণে বিকল্প রাস্তা তৈরীতে অনিয়মের কারণে উপজেলার সাথে উত্তর গোয়াইনঘাটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ১২টি ইউপির হাওরাঞ্চলে কুড়িহাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী।
শুধু হাওর নয় উপজেলা সদর সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের মানুষও পানিবন্দী রয়েছেন। গো-মহিষ নিয়ে কৃষকরা রয়েছেন বিপাকে। ৩/৪ দিনের ভারীবর্ষনে আর আকষ্মিক পাহাড়ি ঢলে শ্রমজীবী মানুষের মানবেতর দিন কাটছে। পানি দ্রুত বাড়ছে, বর্ষণও রয়েছে অব্যাহত। রাতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে এমন শঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউএনও তাহমিলুর রহমান বলেন— আকষ্মিক পাহাড়ি ঢল নেমেছে। মানুষ পানিবন্দী আছেন, আমরা সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।