জেল নয়, ফুল ও বই হাতে বাড়ি ফিরলেন ২৫ দম্পতি আর ৬৫ শিশু
সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার পালইছড়া গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক (৫৫)। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্ত্রী ও দুই শিশুসহ আবু বক্করের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তারই আপন চাচাতো বোন। তার ছেলে স্কুলের ও মেয়ে কলেজ শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন তিনি। বুধবার আদালতের রায়ে তার দুই সন্তান মামলা থেকে রেহাই পান।
এতে খুশি আবু বক্কর সিদ্দিক বললেন— ‘তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার আপন চাচাতো বোন আমাকে, আমার স্ত্রী ও দুইটি শিশুকে মামলায় আসামি করে হয়রানী করেছে। ছেলেটা নাইনে ও মেয়েটি কলেজে পড়ে। মামলার আসামি হয়ে ছেলে-মেয়েকে আদালতের বারান্দায় আসতে হয়েছে। আজ জজ সাহেব মামলা থেকে আমার দুই ছেলে-মেয়ে মুক্ত করে দেওয়ায় আমরা খুব খুশি।’
শুধু আবু বক্কর সিদ্দিকের সন্তানরাই নয়, একইভাবে মামলায় জড়িয়ে আদালতে দুই বছর আসতে হয়েছিল শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের শ্রীনাথপুর গ্রামের রাসেল মিয়া (২০) ও তার বোন কুসুম বেগম (১৮) কে। তারা শ্রীনাথপুর গ্রামের মৃত সমশের আলীর সন্তান।
রাসেল মিয়া ও তার বোন কুসুম বেগম বললেন— ‘আমরার বাবা নাই, ছোট মানুষ আমরা। সম্পত্তি লইয়া আমার আপন চাচা আমারার বিরুদ্ধে মামলা দিয়া কত কষ্ট দিছে। আমরা মাসে মাসে কোর্টে হাজিরায় আসতাম। জজ সাব মামলা শেষ কইরা দেওয়ায় আমরার খুব উপকার অইছে। অকন আর কোর্ট আওনও লাগত নায়।’
শুধু এই দুটি মামলা নয়ই ‘বিশ্ব ন্যায় বিচার দিবস’ উপলক্ষে ৫২ টি পৃথক মামলায় অভিযুক্ত ৬৫ শিশুকে প্রবেশনে ৬ টি শর্তে কারাগারের পরিবর্তে পতাকা, ফুল ও ডায়রী হাতে দিয়ে সংশোধনের জন্য বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠিয়েছে আদালত। এছাড়াও একই আদালত ২৫ টি নারী ও শিশু মামলায় আপোষ মিমাংসার রায় দিয়েছেন।
বুধবার দুপুরে সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু ও মানব পাচার আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন ব্যতিক্রমী এই রায় দেন। আদালতের এই রায়ে খুশি অভিযুক্ত শিশু ও তাদের স্বজনরা এবং ২৫ দম্পতি। পৃথক ৭৭ টি মামলার নিষ্পত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাড. নান্টু রায় ও সুনামগঞ্জ শিশু ও মানব পাচার আদালতের অতিরিক্ত পি.পি. অ্যাড. হাসান মাহবুব সাদী।
ছাতক উপজেলার উত্তর কুরমা ইউনিয়নের শেওতরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এইএসসি পরীক্ষার্থী মাহফুজুর রহমানও একটি মামলায় আসামি ছিলো।
মামলা থেকে মুক্ত পাওয়ার পর মাহফুজুর রহমান বলে— আমাদের পাশের গ্রাম পলিরটুকের লোকজন একটি মিথ্যা মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছিল। গত দেড় বছর আমি মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছি এবং আদালতে আসা-যাওয়া করছি। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মহোদয়কে যিনি মামলা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আদালতের সবশর্ত মেনে এখন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেব।’
ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ বিলপাড় গ্রামের আহমদ ইলিয়াছ আলীর ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী আহমদ ইমরান বলে— ‘আমি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলাম না। অথচ প্রতিহিংসায় আমাকে আসামী করে হয়রানী করা হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে মামলার আসামী হিসেবে আমি আদালতে আসা-যাওয়া করেছি। মামলার কারণে প্রতি মাসে আমাকে আদালতে আসতে হতো। এতে পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিচারক স্যার মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেওয়া খুব ভালো হয়েছে, আমি খুবই আনন্দিত।’
আদালত সূত্রে জানা যায়— সুনামগঞ্জের ৫২ টি পৃথক মারামারি এবং ছোট খাট চুরির মামলায় ৬৫ শিশুকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে জড়ানো হয়েছিল। যার কারণে এসব শিশুদের আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ ও শিক্ষা জীবন ব্যাহত হচ্ছিল। তাই ৬টি শর্তে শিশুদের এসব অসুবিধা থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে প্রবেশেনে সকল মামলার নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আদালত।
রায় ঘোষণার পর আদালতের কর্মীরা প্রতিটি শিশুর হাতে পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের বই, ফুল এবং একটি ডায়েরি তুলে দেন। রায় ঘোষণার সময় ৬৫ শিশুর মা-বাবা ও স্বজনরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এসময় আদালত সকল শিশুকে তাদের মা-বাবা ও স্বজনদের জিম্মায় দেন।
বিচারকের ৬ টি শর্ত অনুযায়ী শিশুদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা এবং আদালত থেকে দেওয়া ছোটদের জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইটি পাঠ করা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ বা যেকোন কারিগরি বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ, প্রতিদিন অন্তত দুটি করে ভাল কাজ করা এবং তা আদালতের ডায়রিতে তা লিখে রাখা, প্রত্যেকে কমপক্ষে ২০টি করে গাছ লাগিয়ে গাছের পরিচর্যা করা, নিয়মিত ধর্মকর্ম করা এবং বাবা-মায়ের আদেশ নির্দেশ মেনে চলা ও মাদক থেকে দূরে থাকা এবং অন্য কোন অপরাধে নিজেকে না জড়ানো।
এছাড়াও একই আদালতের বিচারক পৃথক ২৫ টি নারী ও শিশু মামলায় আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করে তাদের পরিবারকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যৌতুকসহ নানাবিধ কারণে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে সংসার থেকে বিতাড়িত এই ২৫ নারী তাদের স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিল। বিচারক উভয়ের বক্তব্য শুনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক মিলনের ব্যবস্থা করে মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন।
দুই মাসের শিশু সন্তান ঋত্তিকা দাসকে কোলে নিয়ে আদালতে এসেছিলেন জামালগঞ্জের নিতাইপুর গ্রামের গৃহবধূ প্রীতি রানী দাস (২২)। পাশেই দাঁড়ানো ছিল তার স্বামী দীপচাঁন দাস। আপনারা এখন মিলে মিশে সংসার করবেনতো- বিচারকের এমন প্রশ্নের পর দুইজনই হ্যা সূচক মন্তব্য করেন। এরপর আদালতের পক্ষ থেকে তাদের হাতে ফুল তুলে দেওয়া হয়।
গৃহবধূ প্রীতি রানী দাস বলেন— ‘পারিবারিক ঝামেলা হওয়ায় মামলা করেছিলাম। সন্তানের মুখ দেখে ও পরিবারের শান্তির কথা চিন্তা করে আমরা মিলেমিশে সংসার করব।’
নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় আসামী ছিলেন শাল্লা উপজেলার শরমা গ্রামের আমির হোসেন (২৫)। মামলার বাদী ছিলেন তারই স্ত্রী জুলফা বেগম (২২)। গতকাল ২৫ টি মামলার সাথে তাদের মামলাটিও আপোষ নিষ্পত্তি হয়েছে।
মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী বলেন— ‘৭ মাস আগে ছোট-খাটো বিষয় লইয়া মনোমালিন্য হইছিল। এরপর কয়েক মাস মামলা গাইছি (চালানো) আমরা। জজ সাব মামলা শেষ কইরা মিলাইয়া দেলাইছইন। অকন আমরার মাইজে কোন ঝামেলা নাই।’
তবে শিশুদের ৫২টি মামলার বিষয়ে আদালতের দেওয়া শর্তগুলি সঠিকভাবে পালন হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রতি তিন মাস অন্তর আদালতকে অবহিত করবেন জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমান।
জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমান বলেন— ‘প্রবেশনে থাকা শিশুরা মা-বাবা ও স্বজনদের জিম্মায় থেকে আদালতের নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করছে কী না তা পর্যবেক্ষণ করে আদালতে রিপোর্ট জমা দেব।’
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন ইতোপূর্বে চার দফায় ১৪৫টি মামলায় ২০০ শিশুকে একইভাবে প্রবেশন দিয়ে মামলা থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দিয়েছেন। এবং কয়েক দফায় তিনি আরও ২২৫ টি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা আপোষে নিষ্পত্তি করে তাদের পরিবারকে মিলনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত পাঠিয়েছেন।