ভাঙ্গনে জমি-বাড়ী হারাচ্ছে সুরমাপাড়ের মানুষ : স্থায়ী সমাধান চান এলাকাবাসী
স্টাফ রিপোর্টার
সিলেটকে মায়ের মত জড়িয়ে রেখেছে সুরমা নদী। এই নদীর কারণে গড়ে উঠেছে গ্রাম, গ্রাম থেকে জনপদ, লোকালয় ও শহর বন্দর। কিন্তু সেই সুরমায় বিলীন হতে যাচ্ছে সুরমা পারের মানুষের সহায় সম্বল ঘর-বড়ী। নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় মানুষের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে থাকছে সদর উপজেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের কয়েকটি পরিবার। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও ধীরগতির কাজের ফলে সুরমা পাড়ে এখনো কোন রকম ঠিকে থাকা মানুষগুলোর মাথাগুজার ঠাই বসতভিটা বিলীন হতে চলেছে নদীগর্ভে।
স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা গেছে— সিলেট সদর উপজেলা কান্দিগাঁও ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের হেরাখলা এবং মোগলগাঁও ইউনিয়নের যোগীরগাঁও গ্রাম এলাকায় বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়া মোগলগাঁও ইউনিয়নের লালারগাঁও, তালুকপাড়া, খালপাড়, মিরেরগাঁও, ফতেহপুর, ফুলকুচি, পিরেরগাঁও, আঁকিলপুর ও নোয়াগাঁওয়ের একাংশে সুরমা নদীর তীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে সংশ্লিষ্ট গ্রামের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাও ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের নদীরপাড়ের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা অনেকটা ভাঙ্গাগড়ার খেলায় পরিণত হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি এসব এলাকার বাসিন্দা এই ভাঙ্গাগড়ার শঙ্কা থেকে তারা মুক্তি চান। সর্বনাশা ভাঙ্গনের হাত থেকে নিজেদের বসতভিটা রক্ষায় তারা চান স্থায়ী সমাধান।
স্থানীয়রা জানান— সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত কয়েক শ’ বছরের প্রাচীন হেরাখলা গ্রামটি এখন নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, কবরস্থান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদী গ্রাস করেছে। নদীর উত্তর পারে চর জেগেছে। বসতভিটা হারিয়ে অনেক পরিবার উত্তর পারের চরে আশ্রয় নিয়েছে। ৬০ বছরের পুরোনো মসজিদটি ভাঙনের কবলে পড়ে অর্ধেক ইতিমধ্যে নদীতে। ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা অনেকে আতঙ্কিত হয়ে বসবাস করছেন। পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের পাশে নতুন যে চর জেগে উঠেছে, সেখানে নয়াবস্তি নাম দিয়ে বসতি গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ বাসিন্দাই হেরাখলা গ্রাম থেকে আসা ঘরবাড়ি হারানো মানুষ।
সেই গ্রামের বাসিন্দা তোতা মিয়া (৮০) বলেন— তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ গৃহস্থ ছিলেন। তাঁর ২০ কাঠা ফসলি জমি ও ৭টি গরু ছিল। বিভিন্ন জাতের গাছসহ একটি সুন্দর বাড়ি ছিল। এখন এসবের কিছুই নেই। গত দেড় দশকে নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এ কয়েক বছরে তাঁর বাড়ি, জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। তিন ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে তিনি এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত। ছেলেরা পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। গ্রামের অনেকেই নদীভাঙনের কবলে পড়ে তাঁর মতো নিঃস্ব।
নদীর উত্তর পারে পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের পাশে নতুন যে চর জেগে উঠেছে, সেখানে নয়াবস্তি নাম দিয়ে বসতি গড়ে উঠেছে। এখানের অধিকাংশ বাসিন্দাই হেরাখলা গ্রাম থেকে আসা ঘরবাড়ি হারানো একটি পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপকালে তারা জানান— নদীর এই মাঝখানে হেরাখলা গ্রাম ছিল। সেখানে আমাদের বাড়ি ছিল। দাদা-দাদিসহ স্বজনদের কবরও ছিল। এখন আর কোনো চিহ্ন নেই। শুধু স্মৃতি হয়ে আছে। নদীর এপারে এসে সরকারি খাসজমিতে পরিবার নিয়ে থাকছি।’
নদীর পারেই ষাটোর্ধ্ব আমিরুননেছার ঘর। নদীভাঙনে দুই দফা ঘর সরিয়েছেন। তবে গত মাসে তাঁর ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন— ‘বড় বড় ফাটা (ফাটল) আর ভাঙা। বাড়ির মায়ায় ফাটা দেইখা–ও ডরাইয়া (ভয়ে) ডরাইয়া ঘরে আছলাম। নদীর ভাঙনে দুইবার ঘর সরাইছি। তিনবারের সময় আমার সব শ্যাষ!’
আমিরুননেছার মতো শতাধিক মানুষের ঘর গত কয়েক দশকে সুরমা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব বাসিন্দার অবস্থান সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের হেরাখলা গ্রামে। আমিরুননেছা বলেন— ঘর হারিয়ে চার সন্তান নিয়ে তিনি এখন অন্যের বাড়িতে থাকেন। স্বামীর রেখে যাওয়া ফসলি জমিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সব হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব।
ভাঙনের শিকার গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেন— হেরাখলা একটি প্রাচীন গ্রাম। এখানে গ্রামে প্রায় ২০০ পরিবারের বসবাস ছিল। নদীভাঙনের শিকার হয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। এখন মাত্র ৬০টি পরিবার বসবাস করছে। এর মধ্যে অনেকেই অন্যের জায়গায় ঘর করে থাকছেন।
এ বিষয়ে কান্দিগাও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মনাফ এই প্রতিবেদককে বলেন— গেল সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মহোদয়ের উপস্থিতিতে পাউবো নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আমরা একটি বৈঠকে বসেছিলাম। সেই বৈঠকে মন্ত্রী মহোদয়ের নিদের্শ ছিল নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ। মন্ত্রীর নির্দেশক্রমে পাউবো নেতৃবৃন্দ নদী ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ব্লক বসানো সহ নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন।
তিনি বলেন— আমাদের দাবী হলো এই ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ। কারণ ভাঙন ঠেকাতে না পারলে নদী পাড়ের গ্রামগুলো বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবিলম্বে ব্লক বসানো সহ কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন— হেরাখলা গ্রামের ভাঙনকবলিত স্থান আমরা পরিদর্শন করে এসেছি। ভাঙ্গনরোধে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু হবে। তবে বরাদ্দ পেতে মোটামুটি ভালো সময় লেগে যেতে পারে।
তিনি বলেন— ওই এলাকার নদী ভাঙ্গন অনেক গভীরে চলে গেছে। কিছু কিছু ভাঙ্গন এলাকা খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। এসব ভাঙ্গনে ৪/৫ হাজার বালুর বস্তায় কিছুই হবেনা। এরপরও বরাদ্দ পেলে আমরা প্রথমে বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙ্গন ঠেকাতে চেষ্টা করবো। এরপর রিকভার করে ব্লক বসানো হবে। স্থায়ী সমাধান অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এরপরও সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক রয়েছে।