৪৮ বছর পর বাবাকে পেয়েছেন, এবার মায়ের অপেক্ষায় কালা মিয়া
অতিথি সংবাদদাতা
শাকিলা ববি : দেশ স্বাধীন হয়েছে বছর দুয়েক হবে। কালা মিয়ার বয়স তখন ৬ মাস। সেসময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মায়ের সাথে ঝগড়া করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান তার বাবা মো আমজদ আলী। তাই কখনো বাবা বলে কাউকে ডাকার সুযোগ হয়নি তার। এমনকি বাবার আদর যত্ন ভালবাসা পাননি কালা মিয়া। তবে দীর্ঘ ৪৮ বছর পর কালা মিয়ার বাবা ডাকার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ফিরে পেয়েছেন বাবাকে। এখন তিনি তাঁর মাকে ফিরে পেতে চান।
চলতি মাসের ৯ তারিখ হঠাৎ কালা মিয়ার মোবাইলে তার পৈত্তিক বাড়ি ময়মনসিংহ থেকে তাকে কল দেন এক আত্মীয়। ওই আত্মীয় জানান— কালা মিয়ার খুঁজে তার বাবা দেশে এসেছেন। এই খবর পেয়ে ৯ তারিখ রাতেই কালা মিয়া তার ছেলে নাতি নাতনিসহ সপরিবারে ময়মনসিংহ রওয়ানা হন। দীর্ঘ ৪৮ বছর পর জন্মদাতা পিতাকে চোখের সামনে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন কালা মিয়া। বাবা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদেন। তার বাবাও ছেলেকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন। এরপর কালা মিয়া বাবাকে নিয়ে ফেরেন সিলেটে।
কালা মিয়া বলেন— সিলেট মহানগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় স্ত্রী, ছেলে, নাতি নাতনি নিয়ে আমি বসবাস করি। আমাদের মূল বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা থানায়। আমার মা হাজেরা খাতুনের বাবার বাড়ি নেত্রকোনা জেলার বারাড্ডা থানায়। আমি বড় হওয়ার পর শুনেছি আমার মায়ের সাথে ঝগড়া করে বাবা চলে যান ভারতে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৬ মাস। এরপর আমার বয়স যখন ৮ হবে তখন আমার মা কুষ্টিয়া চাকরিতে যাওয়ার সময় একদল দুর্বৃত্তের হতে পরেন। তখন তারা আমার মাকে অপহরণ করেন। এরপর আর মায়ের কোনো খোঁজ পাইনি। প্রায় ১২ বছর পর পাকিস্তানের করাচি থেকে আমার মা চিঠি পাঠান।
তখন তিনি চিঠিতে জানান— তিনি পাকিস্তানে আছেন। সেখানে তিনি স্থানীয় একজনকে বিয়ে করেন এবং সেখানে তার পাঁচ সন্তান রয়েছে। কিন্তু মায়ের চিঠি বা ছবি সংগ্রহ করা বা মায়ের সাথে যোগাযোগ করার মত বোধ বা সুযোগ তখন আমার ছিল না।
কালা মিয়া বলেন— এখন বাবাকে ফিরে পেয়ে মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কারণ আমি এখন জানি না আমার মা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। যদি আমার মা বেঁচে থাকেন তাহলে একবার হলেও আমি আমার মাকে দেখতে চাই। আল্লাহর কাছে এখন এটাই আমার চাওয়া। আমি বাবাকে খুঁজে পেয়েছি, এটিই আমার কাছে বড় আনন্দের খবর। এখন সবাইকে নিয়েই আমি সুখে থাকতে চাই। বাবা যেভাবে ফিরে এসেছেন আশা করি আমার মাও ফিরে আসবেন।
কালা মিয়া জানান— জীবিকার তাগিদে ময়মনসিংহ থেকে সিলেটে চলে আসেন তিনি। টুকিটাকি ব্যবসা শুরু করেন। সিলেটেই বড় হয়েছেন তিনি। একসময়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তিনি চার সন্তানের জনক। সিলেটে থাকছেন ৩৫ বছর ধরে।
কালা মিয়ার বাবা মো. আমজদ আলী বলেন— স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে ৪৮ বছর আগে ঘর ছেড়েছিলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভারতে চলে যাই। ওই সময় ৬ মাসের ছেলেকে রেখে যাই। পরবর্তীতে স্ত্রী সন্তানের খোঁজখবর নিয়েও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ইদানীং আমার ছেলেকে দেখার জন্য খুব টান পরে। যারা দেশে নিয়মিত ভারত থেকে আসে তাদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়েও ছেলের খবর পাচ্ছিলাম না। তাই আমি নিজেই বাংলাদেশে চলে আসি। এখানে এসে আমার বাড়ি ময়মনসিংহে যাই। কিন্তু সেখানে তারা কেউ জানে না আমার ছেলে কোথায় আছে। পরে আমি আমার শালিকার বাড়িতে গিয়ে ছেলের খোঁজ পাই। মোবাইল ফোনে কথা বলে আমার ছেলেকে আসতে বলি। তখন তারা ময়মনসিংহ গিয়ে আমাকে সিলেট নিয়ে আসে। আমি ছেলে রেখে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে ছেলের পাশাপাশি পেয়েছি নাতি ও পন্তি। দীর্ঘ বছর পর আমার ছেলেকে পেয়ে আমি অনেক খুশি হয়েছি।
আমজদ আলী জানান— বর্তমানে তিনি ভারতের নাগরিক। ভারতে গিয়ে তিনি আবারও বিয়ে করেন এবং সেখানে তার চার সন্তান রয়েছে।
কালা মিয়ার ছেলে ও আমজদ আলীর নাতি সুজন মিয়া বলেন— এত বছর ধরে আমার বাবা নিজের বাবাকে ডাকতে পারেননি। আমি কখনো দাদা বলে কাউকে ডাকতে পারিনি। তাই দাদাকে পেয়ে অনেক খুশি। ছোটবেলা থেকে দাদা-দাদির কাউকেই দেখিনি। মনে আশা ছিলো তাদেরকে একদিন ফিরে পাবো। আজ আমাদের সবার আশা পূরণ হয়েছে। এখন আমরা দাদাকে যেভাবে ফিরে পেয়েছি ঠিক সেভাবে আমার দাদীকে ফিরে পেতে চাই।