একসঙ্গে স্ত্রী-মেয়ের লাশ নিয়ে এগোতে পারলেন না অ্যাম্বুলেন্সচালক ফারুক
স্টাফ রিপোর্টার

শোকে যেন অ্যাম্বুলেন্সচালক ফারুকের চোখের জ্বল শুকিয়ে গেছে। গতকাল সোমবার দুপুরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । ছবি : সংগৃহীত
সিলেটের বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা ফারুক আহমদ (৪৮)। প্রায় ২২ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালান। পেশার কারণেই দীর্ঘদিন বহু লাশ ও রোগী বয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। এ নিয়ে অনেক স্মৃতি তার। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে একসঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানের লাশ তোলার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে—এমনটি তার দুঃস্বপ্নেও আসেনি। তাই স্ত্রী–সন্তানের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের চালকের আসনে বসেও তিনি আর এগোতে পারলেন না।
সোমবার দুপুরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ফারুক আহমদ বলছিলেন— এমন পরিস্থিতিতে আর কেউ যেন না পড়েন।
গত রবিবার বিকেলে সিলেটের গোলাপগঞ্জের হাজীপুর এলাকায় ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। তাদের দুজন হলেন— বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার নয়াগ্রামের বাসিন্দা ফারুক আহমদের স্ত্রী রাশেদা বেগম (৩৮) ও মেয়ে ফারিয়া আক্তার (১৬)। রাশেদা বেগম বিয়ানীবাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাবুর্চির কাজ করতেন। ফারিয়া আক্তার সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষা পাসের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে— রাশেদা বেগম চিকিৎসক দেখানোর জন্য রোববার বিকেলে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে সিলেটের দিকে রওনা হয়েছিলেন। সঙ্গে মেয়ে ফারিয়া আক্তার বইপত্র নেওয়ার জন্য মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল। পথে ট্রাকের সঙ্গে অটোরিকশাটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে এসে ফারুক আহমদ জানতে পারেন, স্ত্রী রাশেদা বেগম দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন ও মেয়ে গুরুতর আহত। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দিবাগত রাত ১২টার দিকে মেয়ে ফারিয়া আক্তারেরও মৃত্যু হয়।
স্ত্রী ও মেয়ে হারানোর শোকে ফারুক মিয়া তেমন কথা বলতে পারছিলেন না। শোকে যেন ফারুকের চোখের জল শুকিয়ে গেছে। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন সহকর্মী অন্য অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরা। দুপুরে দুটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মা ও মেয়ের লাশ বিয়ানীবাজারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। এ সময় স্বজনেরা ভিড় জমাচ্ছিলেন হাসপাতালের মর্গের সামনে।
রাশেদা ও ফারুক দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে ফারহানা আক্তার সিলেটে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করছেন। ছোট ছেলে ফরহাদ হোসেন পড়ে নবম শ্রেণিতে।
লাশবাহী দুটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আবদুস সালাম নামের এক চালক। তিনি বলেন— ফারুক আহমদ একসময় অন্যের অ্যাম্বুলেন্স চালালেও বর্তমানে তার দুটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। একটি নিজে মাঝেমধ্যে চালন, অপরটি ভাড়ায় দেন।
আবদুস সালাম বলেন— হাসপাতালের লাশঘর থেকে মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে আসার সময় তিনি একটু বাইরে ছিলেন। সে সময় ফারুক আহমদ লাশ নিয়ে মর্গে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের চালকের আসনে উঠে বসেন। কিন্তু তিনি আর চালিয়ে আসতে পারেন না। পরে তিনি এসে অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যান।
গাড়ি চালানোর সময় চালকদের আরও সচেতন হওয়া উচিত উল্লেখ করে আবদুস সালাম বলেন— নিজেদের পরিবারের সদস্যদের ওপর এমন ঘটনা না ঘটলে বিষয়টি অনেকে বুঝতে চান না।