মুসলিম প্রধান জেলা মালেরকোটলার সৃষ্টিকে ঘিরে ভারতে বিতর্ক
সময় সংগ্রহ :
ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে একটি নবাবী আমলের শহরের নাম মালেরকোটলা। ইতিহাস বলে, প্রায় পৌনে ৬০০ বছর আগে আফগানিস্তান থেকে আসা ধর্মগুরু শেখ সদরউদ্দিন-ই-জাহান এই নগরের পত্তন করেছিলেন। তার বংশধর বায়াজিদ খান ১৬৫৭ সালে মালেরকোটলা নবাবীর সূচনা করেন, আর সেখানকার শেষ নবাব ইফতিকার আলি খান প্রয়াত হন ১৯৮২ সালে।
এখন ওই মুসলিম-প্রধান মালেরকোটলাকে পাঞ্জাবের আলাদা একটি নতুন জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং।
জানানো হয়েছে- এখনকার সাংরুর জেলা থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে পাঞ্জাবের এই ২৩তম জেলা। ডেমোগ্রাফির দৃষ্টিতে নতুন এই জেলায় মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন।
গত শুক্রবার (১৪ মে) ঈদের দিন অমরিন্দর সিং ঘোষণা করেন- এই ঐতিহাসিক দিনে আমি মালেরকোটলার জন্য কিছু করতে পেরে গর্বিত। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পাটিয়ালা রাজবংশের সাথে মালেরকোটলার নবাবদের দারুণ সুসম্পর্ক ছিল, নবাব ইফতিকার আলী খানকে আমি ডাকতাম ‘চাচাজি’ বলে।
ঐতিহাসিকভাবেই সারা বিশ্বের শিখ সম্প্রদায়ের স্মৃতিতে মালেরকোটলার একটা আলাদা জায়গা আছে, সম্মান আছে। পাঞ্জাব ক্যাবিনেটের একমাত্র মুসলিম সদস্য রাজিয়া সুলতানাও জানান- আলাদা মেডিক্যাল কলেজ, মহিলা কলেজ, মহিলা থানা ও বাসস্ট্যান্ড স্থাপনের ঘোষণা করে সরকার মালেরকোটলাকে ঈদের উপহারে ভরিয়ে দিয়েছে। এই প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়ছে বিপুল অঙ্কের অর্থও, যাতে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা খরচ হবে বলেও ধরা হচ্ছে, বলেন মিস সুলতানা।
পাঞ্জাব সরকারের এই ঘোষণার পরদিনই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ টুইট করেন- বিশ্বাস বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বিভেদ করা ভারতীয় সংবিধানের মূল আদর্শের বিপরীত। কাজেই মালেরকোটলাতে আলাদা জেলা তৈরি করা কংগ্রেসের বিভাজনকারী নীতিরই পরিচায়ক, আরো মন্তব্য করেন তিনি।
মালেরকোটলার শিখ ও মুসলিমরা অবশ্য তার এই ব্যাখ্যা মানতে প্রস্তুত নন। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন- বেশ কয়েক শ’ বছর ধরে এই শহরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চমৎকার সম্প্রীতির একটা পরম্পরা আছে।
পাঞ্জাব গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক সমিতির সদস্য অজিত সিং যেমন গণমাধ্যমকে বলছিলেন- শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংয়ের দুই বাচ্চা ছেলেকে ১৬৫৭ সালে মুঘল গভর্নর ওয়াজিদ খান সরহন্দে দেওয়ালের ইঁটে জীবন্ত চাপা দিয়ে মেরেছিলেন। তখন কিন্তু মুসলিম হয়েও মালেরকোটলার নবাব শের মোহাম্মদ খান তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তখন থেকেই শিখরা মালেরকোটলার প্রতি চরম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মহম্মদ খলিলও গণমাধ্যমকে জানান- সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ও মালেরকোটলায় কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়নি। তার কথায়, শিখ ও মুসলিমরা তখন পরস্পরের মধ্যে সম্পত্তি বিনিময় করে এপার-ওপার করেছেন… কিন্তু শহরে সাম্প্রদায়িকতার কোনো আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। পৃথক মালেরকোটলা জেলার গঠনকে তাই শিখ ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবেই পাঞ্জাব দেখছে।
রাজনৈতিক ইসলামের গবেষক ও অধ্যাপক মঈদুল ইসলাম আবার গণমাধ্যমকে বলছিলেন- মহামারি সামলানোর ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরাতেই আদিত্যনাথ মালেরকোটলাতে সাম্প্রদায়িকতার রং চড়াচ্ছেন বলে তার বিশ্বাস।
ড. ইসলামের কথায়- ‘উত্তরপ্রদেশে বিজ্ঞানের চর্চা কখনওই ছিল না, আর বিজেপি-শাসিত এই রাজ্যটি যে কোভিড একেবারেই সামলাতে পারেনি তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন। ফলে যখনই দেশের কোথাও একটা সংখ্যালঘু বা মুসলিম সিম্বলিজমের জায়গা তৈরি হচ্ছে, কোভিড সমালোচনা থেকে পাশ কাটাতে সেটা নিয়ে এ ধরনের টুইট, বা প্ররোচণামূলক কথাবার্তার অবতারণা করা হচ্ছে। আমি তো বলব আদিত্যনাথের এই টুইট একেবারে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার চেষ্টা, মন্তব্য মঈদুল ইসলামের।
পাঞ্জাবের বিজেপি এমপি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সোমপ্রকাশ অবশ্য রোববার আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে গিয়ে মালেরকোটলা জেলার গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু পাঞ্জাবের মুসলিমদের জন্য আলাদা একটা জেলার আদৌ কী দরকার ছিল, বিজেপির তরফে এই ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা এরপরও থেমে নেই।
সূত্র : বিবিসি