সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মঠরঘাটের পাশাপাশি মাজার-মন্দির
অতিথি সংবাদদাতা
আহমাদ সেলিম : সনাতন ধর্মের শিব মন্দিরে অনুষ্ঠান চলছে। সকাল থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে পূণ্যার্থীরা ধর্মীয় কাজে পরিবার পরিজন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অন্যদিকে দুপুর গড়িয়ে আসছে। জোহরের আযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মসজিদের মোয়াজ্জিন।
যথারীতি আজানের আগেই বন্ধ হয়ে গেল মন্দিরের আরাধনা, আলোচনা। সিলেটের বিমানবন্দর সড়কের মঠরঘাটবাজারের পাশে থাকা মাজার-মন্দির এবং অন্যপাশে মসজিদ ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ নিদর্শন চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বন্ধনের ধারাবাহিকতা চলে আসছে যুগের পর যুগ।
বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির ভাসমান বন বা সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেখানে প্রকৃতিপ্রেমিরা ছুটে আসেন। করোনা মহামারির কারণে কিছুটা নিরব থাকলেও সম্প্রতি আবার সরব হয়ে ওঠেছে দৃষ্টিনন্দন জলার বনটি। সেই বনের সহিষ্ণু জল ছোয়ার আগে ছোট যে বাজার মাড়াতে হয় তার নাম মঠরঘাট বাজার। সেই মঠরঘাট বাজারে পর্যটকদের গাড়ি রাখার নির্দিষ্ট স্থানের পাশেই রয়েছে তিনশত ষাট আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত শাহ কামাল রহ. এর মাজার।
মাজার ঘেঁষেই রয়েছে একটি মন্দির, যার নাম শিব মন্দির। যারাই মঠরঘাট হয়ে রাতারগুল বেড়াতে আসেন পাশাপাশি থাকা মাজার এবং মন্দিরের সহ-অবস্থান তাদেরকে আন্দোলিত করে। আর এ চিত্র দেখে এবং এ অঞ্চলের মানুষের সম্প্রীতি দেখে তারা অভিভূত হন। অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে দিনশেষে তারা বাড়ি ফিরেন। স্থানীয় বেশ কয়েকজন জানান- মাজার এবং মন্দিরের মতো মাঠেরঘাট বাজার এবং আশপাশের মুসলিম এবং হিন্দু পরিবারের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনও কাছাকাছি রয়েছে। সেটি চলে আসছে যুগের পর যুগ।
মাজার এবং মন্দিরের পাশে মঠরঘাট নয়াগ্রাম, চানপুর, চইলতাবাড়ি, কুমারপাড়া, এওলাটুক’সহ আরও কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। সবগুলো গ্রামেই উভয়ধর্মের মানুষ বসবাস করছেন। পরিবার এবং সমাজজীবনে ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ হলেও ধর্ম নিয়ে কিংবা মন্দির-মাজার নিয়ে কারো মধ্যে কোনো মনোমালিন্য, এমনকি কথা কটাকাটিও হয়নি।
স্থানীয় চাঁদপুর স্কুলের সাবেক সভাপতি ষাটোর্ধ্ব উমেদ আলী দীর্ঘ আলাপে এ বিষয়ে তার স্মৃতি রোমন্থন করেন। বলেন- ‘আমি ছোটবেলায় বাবার সাথে বাজারে যেতাম। তখন থেকে এখন পর্যন্ত দেখছি, দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্ম কিংবা মাজার-মন্দির নিয়ে কোনো ধরণের মনোমালিন্য হয়নি। গ্রামের ঘরে ঘরে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ খুব না থাকলেও বড় এবং উদার মনের মানুষরা উদাহরণ হয়ে বহু।’ তিনি বলেন- ‘একসময় মন্দিরে কীর্তন হতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন। সেই কীর্তন যাতে সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে হয়-সেজন্য বাস্তবায়ন কমিটিতে মুসলমানদেরও রাখা হতো। একবার সেই কমিটির আমিও সদস্য ছিলাম।’
এখনও সহযোগিতার মনমানসিকতা রয়ে গেছে। মাজার, মন্দিরের অন্যপাশে যে মসজিদ রয়েছে সেই মসজিদে যখন নামাজ হয়, তখন মন্দিরের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। কেউ কারও প্রার্থনার ব্যাঘাত ঘটান না কখনো। দুই তরফ থেকেই সচেতন দৃষ্টি রাখা হয় যেন অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রার্থনায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। এ কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের মঠরঘাট, আমাদের মাজার মন্দির।’
মাজার এবং মন্দিরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন চানপুর স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় কুমার নাথ। তিনি জানান- ‘মাজার এবং মন্দিরের বাজার কিংবা পাশের গ্রামের মানুষজন খুবই শান্তিপ্রিয়। এক ধর্মের মানুষ, অন্য ধর্মের অনুসারীদের সব সময় সম্মান করেন। এই সম্মান বহু পুরনো’।
কুমারপাড়া গ্রামের সুমন জানান- ‘কয়েকশ’ বছর ধরে ভিন্ন ধর্মের দুটি প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি থেকে যার যার মতো করে ধর্মীয় রীতি পালন করছে। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসাধারণ একটি উদারহরণ।’
একইগ্রামের ঝলক কান্তি দেব বলেন- বছরের পর বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম যার যার অবস্থানে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় কর্মকান্ড চালিয়ে আসছেন। এ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো বৈরী অবস্থা তৈরি হয়নি।’
মঠরঘাটে ব্যবসা করছেন, এমন কয়েকজনের সাথে আলাপ হলে তারা বলেন- দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটলেও এখানে ছিল ব্যতিক্রমী চিত্র। উল্টো তারা একে অপরের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষায় উদাহরণ হয়ে আছেন।
মঠরঘাট বাজারের পুরনো ব্যবসায়ী, মহাদেব লেডিস এন্ড জেন্টস টেইলার্সের রতন বিশ্বাস বলেন- ‘নামাজের সময় কোনোদিন মন্দিরে ঘন্টা বাজেনা কিংবা মন্দিরে অনুষ্ঠানেও কোনো ঝামেলা হয়না।’
মসজিদে নামাজ পড়তে আসা প্রবীণ মুরব্বি জামাল মিয়া জানান- বাংলাদেশ একটি সম্প্রীতির দেশ। সে দিক থেকে মঠরঘাটের মসজিদ, মাজার ও মন্দির অনেক উচুস্থানে নিয়ে গেছে। এই সম্প্রীতি বাংলাদেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ুক-এটাই আমাদের কাম্য।