শিশুকে কখন-কী-কতোক্ষণ দেখাবেন
লাইফস্টাইল ডেস্ক
টেলিভিশন তো ছিলই, স্মার্টফোনও এখন শিশুদের হাতের নাগালে। শিশুদের অনেকটা সময় কাটে স্মার্টফোন ও টেলিভিশন দেখে। কিন্তু শিশুকে কী কতোক্ষণ দেখাবেন—এ বিষয়ে পরামর্শ দিলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার। লিখেছেন আতিফ আতাউর
কর্মজীবী মায়েরা তো বটেই, অনেক সময় গৃহিণীরাও সন্তানকে শান্ত রাখার জন্য স্মার্টফোন বা ট্যাব ধরিয়ে দেন। শুধু তা-ই নয়, সন্তান যাতে স্মার্টফোন পেয়ে ব্যস্ত থাকে এ জন্য চটকদার ভিডিও চালিয়ে দেন। সন্তান তাতেও সন্তষ্ট না হলে আরেকটি ভিডিও খুঁজে দেন। এখন প্রত্যেকের বাসার প্রায় প্রতিদিনের চিত্র এটি।
শিশুর হাতে স্মার্টফোন দিয়ে তাকে শান্ত রাখা, খাওয়ানো, বর্ণমালা, ছড়া ও কবিতা শেখাতে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন মা-বাবারা। এতে একদিকে তাঁরা যেমন খানিকটা স্বস্তি ও ফুরসত পাচ্ছেন, অন্যদিকে শিশুদের স্মার্টফোনের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
এটি ঠিক যে পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত স্মার্টফোন ব্যবহারে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। শিক্ষামূলক নানা অ্যাপস ও অনুষ্ঠান দেখে শিশুদের সৃজনশীলতা বাড়ে, জানার আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু এর বেশি ব্যবহার আমাদের অজান্তেই শিশুর জন্য ডেকে আনতে পারে ভয়ানক বিপদ। বড়দের উদাসীনতার কারণে শিশুরা স্মার্টফোনে আসক্তও হয়ে পড়তে পারে। আবার টেলিভিশনেও মাত্রাতিরিক্ত কার্টুন, কমিকস দেখার ফলও ভালো হয় না। এ জন্য বুঝেশুনে শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহার ও টেলিভিশন দেখতে দেওয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরই আগে সচেতন হতে হবে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, বড়দের অনুকরণ করতে চায়। তাদের সামনে আমরা যা যা করি, তারা সেটাই করতে চায়। শিশুর সামনে সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে বসে থাকলে সেও সেটাই করতে চাইবে। কার্টুন, কমিকস এমনিতেই শিশুদের ভালো লাগার বিষয়। তাই বলে সব সময় এজাতীয় অনুষ্ঠানে শিশুকে ব্যস্ত রাখা অনুচিত। ধীরে ধীরে শিশুর মধ্যে স্মার্টফোন ও টেলিভিশন দেখার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। কোনটা কতক্ষণ দেখবে, তা-ও সচেতনভাবে মা-বাবাকে নির্ধারণ করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুকে যা দেখাবেন, অবচেতনভাবে তা-ই তার মনে প্রভাব তৈরি করবে।
সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া :
শিশুকে খাবার খাওয়াতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় মায়েরা স্মার্টফোন হাতে দেন। নয়তো টিভির সামনে বসিয়ে খাওয়ান। শিশু তখন কী খাচ্ছে, খাবারের রং কী, খাবারটি দেখতে কেমন এগুলো না জেনেই গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকে। এভাবে খাওয়ানো মোটেই উচিত নয়। শিশুকে খাওয়ানোর সময় তাকে খাবারটির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া খুব জরুরি। এটি শিশুদের মন ও মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে খাবার হজম প্রক্রিয়াটি সহজ হয়।
আবার শিশুকে ব্যস্ত রাখতে গিয়েও স্মার্টফোন ও টেলিভিশনমুখী করা উচিত নয়। তাই বলে একেবারে দূরে রাখাও ঠিক নয়। শিশুকে স্মার্টফোন দেখতে দিন, তবে তা অবশ্যই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এই সময় ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশি হওয়া উচিত নয়। কারণ স্মার্টফোন ও টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে বিচ্ছুরিত আলো শিশুদের চোখ ও মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সপ্তাহের ছুটির দিনে পারিবারিকভাবে সবাই মিলে শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখার আয়োজন করতে হবে। স্মার্টফোন ও টেলিভিশন বেশি দেখার বায়না করলে এই দিনটির কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। শিশুরা চাইলেই স্মার্টফোন হাতে দেওয়া যাবে না।
কী দেখাবেন :
শিশুদের শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখতে দেওয়াই ভালো। শিশুদের উপযোগী অনেক শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আছে। এগুলোর মধ্যে শিশু যেটি বেশি পছন্দ করে সেটি দেখতে দিন। তবে শিশুর পছন্দের একটা সেন্সর হওয়া ভালো। তারা পছন্দ করলেও সেটা শিশুর জন্য কতটা ভালো বা মন্দ, তা যাচাই করে তবেই দেখতে দিতে হবে। ইউটিউব, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও টেলিভিশনে শিক্ষামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিতর্ক, কমিকস, কার্টুন, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি, বর্ণমালা, মজার ছড়া পাওয়া যায়। এগুলোর সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। শিশুর জন্য ভালো এমন অনুষ্ঠান দেখতে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে শিশুকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদেরও এসব অনুষ্ঠান দেখতে হবে, যাতে শিশুর মধ্যে ভালো জিনিস দেখার অভ্যাস তৈরি হয়। সপ্তাহে এক দিন শিশুকে নিয়ে পরিবারের সবাই মিলে শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখার আয়োজন করতে হবে। শিশুরা স্মার্টফোনে ভিডিও গেম খেলতে পছন্দ করে। এসব গেমের সবই কিন্তু শিশুদের জন্য ভালো নয়। অনেক গেম শিশুদের ভায়োলেন্ট বা হিংস্র করে তোলে। এ জন্য কোন গেম কতক্ষণ খেলবে, তা-ও শিশুকে আগে থেকে ঠিক করে দিতে হবে। সব গেম চাইলেই খেলতে দেওয়া যাবে না।
নিরাপদ স্মার্টফোন :
স্মার্টফোন এমন এক ডিভাইস, যেটি নিজে থেকেই অনেক কিছু সাজেস্ট করে। সন্তানকে ইউটিউবে শিক্ষামূলক একটি কনটেন্ট দেখতে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এরপর সেটি শেষ হয়ে আরেকটি কনটেন্ট অটো চালু হতে পারে বা সন্তান নিজেই নিচের আরেকটি কনটেন্টে চাপ দিতে পারে, যেটি হয়তো শিশুতোষ কোনো কনটেন্ট নয়। এ জন্য ইউটিউব, ফেসবুক ও ইন্টারনেটের সেটিংস পরিবর্তন করে দিতে হবে।
শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেওয়ার আগে কিডস মুড চালু করে দিতে হবে। এতে শুধু শিশুতোষ কনটেন্টগুলোই দেখতে পাবে সন্তান। এসবের পাশাপাশি শিশুদের সামনে নিজেদেরও স্মার্টফোন দেখা কমিয়ে দিতে হবে। এতে শিশুরাও স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রতি কম আগ্রহী হবে। মনে রাখতে হবে, স্মার্টফোনের আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক।