আবরারের মায়ের আহাজারি, এ লাশ আমি বহন করতে পারবো না
সময় সিলেট ডট কম
মা’র কাছে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার ছিলেন আবরার ফাহাদ। তাকে হারিয়ে পাগলিনী মা রোকেয়া খাতুন। মুহুর্মূহু মুর্ছা যাচ্ছেন তিনি। তাকে সান্তনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সবাই। কে কাকে সান্তনা দেবেন, সবাই অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আত্মীয়-স্বজন, গ্রামবাসী, এলাকার মানুষ, জানা না জানা অসংখ্য মানুষ। সবার হৃদয়ে আবেগ উথলে উঠছে। তার প্রকাশ ঘটছে কান্নায়।
এ এক বীভৎস দৃশ্য বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের গ্রামের বাড়িতে। জন্ম নেয়ার পর তাকে যত মানুষ দেখতে এসেছিলেন, তার চেয়ে শতগুন মানুষ ভিড় করেছেন। রোকেয়া খাতুন চেতনা ফিরে পেতেই আহাজারি করছেন। আছড়ে পড়ছেন। চিৎকার করছেন। বিমর্ষ হচ্ছেন। তিনি কাঁদছেন কেন! তার সন্তান ঘরে ফিরেছে। আনন্দ করার কথা তার। এটা ওটা হাজির করার কথা সন্তানের জন্য। অথচ তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। সোমবার তার সন্তান ঘরে ফিরেছে কাঠে তৈরি কফিনে। নির্বাক। এমন ছেলেকে তো তিনি একদিন আগে বিদায় দেন নি। তার ছেলে তো মা বলে বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দেয় নি। কেন? তার এ প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে। শুধু আছে চারদিকে কান্নার আওয়াজ। বুকফাটা আর্তনাদ। এমন পরিবেশের জন্য, সন্তানের এই পরিণতির জন্য কি তিনি জীবনভর স্বপ্ন দেখেছেন! সব পিতামাতার মতো তিনি সন্তানকে বড় করেছেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন ঘরে ফিরেছে লাশ হয়ে। তিনি তাকে কোথায় রাখবেন!
কুষ্টিয়ার পিটিআই রোডে আবরার ফাহাদের বাড়িতে মা রোকেয়া খাতুনের এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য। চেতনা ফিরতেই তিনি চিৎকার করছেন, আমার সন্তানকে জীবিত ফিরিয়ে দাও। আত্মীয়রা তাকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সবার একই অবস্থা। আবরার ফাহাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাকে রোববার দিবাগত রাতে ফেসবুকে একটি পোস্টের কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে। কিন্তু তাতে কি মা রোকেয়ার মন শান্ত হবে! তিনি কি তার উজ্বল আলোয় আলোকিত এই সন্তান আর ফিরে পাবেন! যে স্বপ্নের দুনিয়া তাকে নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন, সেখানে এখন শুধুই দুঃস্বপ্ন। চিৎকার করে বলছেন, আমাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করো না। এই লাশ আমি বহন করতে পারবো না।
রোকেয়া খাতুন একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষিকা। দু’ছেলের গর্বিত মা। বলেন, আমার ছেলে আমার কাছে আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। দুটি ছেলেকে বড় করতে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নি আমাকে। আবরার সব সময়ই ক্লাসে প্রথম হতো। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে এসব বলছেন তিনি। তিনি বলছেন, আমার সন্তানকে কোথায় এবং কিভাবে পাবো। চেয়ারে বসে এসব বলতে বলতে তিনি বেশ কয়েকবার মুর্ছা যান।
তার ছোট ছেলে সাব্বির ফাহাদ ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। স্বামী বরকত উল্লাহ ব্র্যাকের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা। সোমবার সকালে অকস্মাৎ আত্মীয়-স্বজনরা তার বাড়িতে আসতে থাকেন। একদিনে কেন এত আত্মীয়-স্বজন তার বাড়িতে যাচ্ছেন তা তিনি তখনও বুঝতে পারেন নি। জানেন না তার প্রাণের ধন আবরার ফাহাদ আর নেই। আর কোনোদিন তাকে মা বলে ডাকবে না। আত্মীয়রা তাকে এ খবর জানাতেই যেন প্রলয় শুরু হয়।
আবরারের সঙ্গে রোকেয়া সর্বশেষ ফোনে রোববার বিকাল ৫ টায় কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সে আমাকে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পৌঁছেছে। তারপর রাত ৯টার পরে তিনি অনেকবার তাকে ফোন করেছেন। কিন্তু সেই ফোন আর রিসিভ করতে পারেন নি আবরার। রোকেয়া বলেন, সোমবার ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করতে উঠে পড়ি। দেখি আবরারের বাবা কাঁদছেন। জানতে চাইলাম, কাঁদছো কেন। তিনি বললেন, ছেলের হল থেকে কেউ একজন ফোন করেছিল এবং বলেছে, কিছু সমস্যা হয়েছে। তাই তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা যেতে হবে।
আবরার তার ছোটভাইকে সঙ্গে নিয়ে ২৪ শে সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার বাড়ি যান। অক্টোবরের ২০ তারিখ পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে সেখানে অবস্থান করার পরিকল্পনা ছিল। এক আত্মীয় বলেন, কিন্তু একাডেমিক চাপ থাকায় রোববার সকালে আবরার ঢাকা চলে আসেন। শৈশব থেকেই তিনি ধার্মিক ছিলেন। তবে কখনোই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আবরারের এক আঙ্কেল মিজানুর রহমান বলেছেন, তাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের বাড়ির পাশেই তাদের বাড়ি।
সন্তান হত্যার বিচার চান কিনা এ প্রশ্নে কিছুটা সময় নীরব রইলেন মা রোকেয়া। তারপর তিনি কান্না থামালেন। জানতে চাইলেন, কে তাকে ন্যায়বিচার দেবে। আমি চাই আমার ছেলেকে জীবিত ফিরিয়ে দাও। আমার ন্যায়বিচার দরকার নেই।