ওসমানীনগরের ডাকঘরগুলোতে নেই আগের মতো ভিড়
রায়হান আহমদ
‘এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো। এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তালপাখাটা খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো…’ হেলাল হাফিজের মতো চিঠির জন্য আকুতি ভরা কবিতা এখন আর কেউ লেখে না। হোয়াটসআপ, ইমো, ভাইবার, ফেসবুকের যুগে চিঠির হরফগুলো কেমন অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে উঠেছে।
জানালার গ্রিলে মাথা রেখে কেউ আর অপেক্ষায় থাকে না ডাক পিয়নের। মনমানুষের চিঠির অপেক্ষায় কাউকেই তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা কাতর হতে দেখা যায় না। আগের মত আর চিঠিতে প্রিয়জনের স্পর্শ পেতে প্রাপক কাগজ শুঁকে দেখার সু্যোগ হয় না কারো। আলাদা করে সুগন্ধি মাখানো চিঠিও আসে না কারো কাছে। যুগের বিবর্তনে আধুনিকতার কাছে হার মেনেছে চিঠির আবেগ-ভালবাসা। হারিয়ে গেছে গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে ছুটে আসা সেই ডাকপিয়নের সাইকেলের বেল। কয়েক বছর পূর্বেও চিঠি আদান-প্রদানের জন্য ডাকঘরে লোকজনের যে ভিড় দেখা যেতো তা আজ পরিণত হয়েছে রূপকথায়। অচল হয়ে পড়েছে ডাক বাকসোগুলোও। আর তাইতো ডাকঘরগুলোও কেমন যেনো নিরব, নির্বাক হয়ে সোনালী অতীতের স্মৃতিমন্থনে দাঁড়িয়ে আছে।
সিলেটের ওসমানীনগরের অধিকাংশ লোক ব্রিটিশ আমল থেকে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। এক সময় চিঠিপত্র আদান প্রদানের মাধ্যমে পবিবার পরিজনের খোঁজ খবর রাখতেন প্রবাসীরা। চিঠিপত্র আদান প্রদানের প্রধান মাধ্যম ছিল ডাকঘর। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ই-মেইল’র মতো উন্নত প্রযুক্তির সাগরে পাল্লা দিতে না পেরে তলিয়ে যাচ্ছে ডাক বিভাগ।
মাত্র কয়েক বছরে পাল্টে গেছে ওসমানীনগরের ডাকঘরের চিত্র। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল অবধি ডাকঘরে চিঠি আদান প্রদানের জন্য মানুষের ভিড় ছিলো চোখে পড়ার মতো। সিলেট থেকে ডাক বাকসো আসার পর চিঠির বান্ডেল খোলে ডাক পিয়ন যখন নাম ধরে ডাকতে শুরু করতেন তখন যেনো ক্লাস উপস্থিতির মতো সতর্ক থাকতেন সবাই। নাম ডাকলে যেনো সাড়া দিতে দেরি না হয়। পত্র প্রাপ্তির স্বার্থে ডাক পিয়নের যে কদর ছিলো তাও এখন দেখা যায় না।
সরেজমিন ওসমানীনগরের ৭টি সাবপোস্ট অফিস ও ১১টি শাখা অফিসের মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘুরে দেখা যায় চিঠিপত্র আদান-প্রদানের জন্য মানুষের কোন আনাগোনা নেই। পোস্ট ব্যবস্থাকে সচল রাখতে বর্তমানে ডাক বিভাগের মাধ্যমে জরুরী টাকা আদান-প্রদান, কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রচারের অভাবে তাতে তেমন সাড়া মিলছে না।
প্রবীণ চিঠি লেখক আব্দুর রশীদ বলেন, প্রবাসীদের খবর জানতে ও জানাতে একসময় একমাত্র উপায় ছিল চিঠিপত্র। এবং এর মাধ্যম ছিল ডাক বিভাগ। আমি ডাকঘরের সামনে একটা টুলে বসে থাকতাম। টাকার বিনিময়ে অনেকে আমায় দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিতো। আমি এই আয়ে আমার পরিবার চালাতাম। কিন্তু মোবাইল ফোন আসার পর থেকে চিঠির কদর কমে গেছে। বিগত ১০ বছরের মধ্যে আমাকে কোন চিঠি লিখতে হয়নি কারো জন্য। চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগে যে আবেগ, অনুভূতি ও আবেদন ছিল তথ্য প্রযুক্তির উত্থানে সেই আবেগ বা অনুভূতি অনেকাংশে কমে গেছে।
উপজেলার গোয়ালাবাজার সাব পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার অরুণ চন্দ্র দাশ বলেন, আগের মতো এখন আর পোস্ট অফিসে ভিড় হয় না। প্রবাসের চিঠি আসে না বললেই চলে। কিছু চিঠি এলেও এর বেশীর ভাগই সরকারী বা প্রতিষ্ঠানিক চিঠি।