রায়হান হত্যা : উত্তর মিলছেনা যেসব প্রশ্নের
সময় সিলেট ডট কম
স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে পুলিশি নির্যাতনে রায়হান হত্যাকাণ্ডের রহস্য খোলাসা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের অনেক আলামত প্রকাশ পেয়েছে। তিন পুলিশ সদস্যের আদালতে জবানবন্দির মাধ্যমে এ হত্যার অনেকটা জট খুলেছে। কিন্তু এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলেনি। ‘কেন যুবক রায়হানকে হত্যা করা হলো, কি বা এর উদ্দেশ্য। শুধু কি ১০ হাজার টাকার জন্য রায়হানকে পিটিয়ে খুন করা হলো। আকবরও বা কি করে নিরাপদে পালিয়ে গেলো! কেনই বা গ্রেফতার হচ্ছেনা না টা আইসি হাসান ও কনস্টেবল তৌহিদ’। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আকবরকে ধরতে পারলেই উত্তর মিলবে সকল প্রশ্নের।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই’র ইন্সপেক্টর মুহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের সব মনোযোগ এখন এসআই আকবরের দিকে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। আকবরকে গ্রেফতার করতে পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ইউনিট কাজ করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সাইদুরকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হবে কি না বিষয়ে পিবিআই তদন্ত টিম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, মামলার তদন্তকালীন সময়ে যাকে প্রয়োজন মনে হবে তাকে গ্রেফতার করা হবে।
এদিকে, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার এএসআই আশেক এলাহিকে গ্রেফতার করলেও ফাঁটির টু আইসি হাসান উদ্দিন এখনো গ্রেফতার হননি। এছাড়া ঘটনার দিন যে মোবাইল দিয়ে রায়হানের মাকে কল করে টাকা চাওয়া হয়েছিলো সেই মুঠোফোনের মালিক কনস্টেবল তৌহিদকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ পর্যন্ত আলোচিত এই হত্যা মামলার তিন পুলিশসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এরমধ্যে শেখ সাইদুর রহমান নামের একজন পুলিশের সোর্স। তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
অপরদিকে, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে যুবক রায়হান হত্যার ঘটনায় জনমনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল, অবরোধ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালিন করলেও গ্রেফতার হয়নি প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর। হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো সে লাপাত্তা। আকবর কোথায় আছে? এ প্রশ্নে উত্তর নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তবে অনেকে বলছেন হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা আকবর পুলিশের হাতের মুঠোয় আছে। তবে ভিন্ন কথা বলছেন পুলিশের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আকবর তাদের নাগালের বাইরে, তাকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
পিবিআই সুত্র জানিয়েছে, নিহত রায়হানকে ছিনতাইকারি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো শেখ সাইদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তিকে পরবর্তীতে শনাক্ত করে পিবিআই হেফাজতে নেয়া হয়। গত রোববার তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। সাইদুর বন্দরবাজার পুলিশের সোর্স হতে পারে। তাকে দিয়ে ঘটনাটি নাটক সাজানো হতে পারে। সুতরাং পিবিআই তদন্তের স্বার্থে আপাতত তাকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করেছে। প্রয়োজন হলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সুত্র জানায়, সর্বত্র আলোচনায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। একে একে বেরিয়ে আসছে ফাঁড়ি এলাকার সব ভয়ঙ্কর চিত্র। ইনচার্জ এসআই আকবরের অপরাধ হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা ছিলো এসআই হাসান, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল তৌহিদ, টিটুর। তারা সবাই মিলেই বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নানা বিতর্কিত ঘটনা ঘটাতো। রায়হানকে নির্যাতনের আগে এবং পরে হাসান ও আশেক এলাহি’র ভূমিকাও ছিলো বিতর্কিত। সেদিন পুলিশের সোর্স সাইদুরের কথামতো রায়হানকে ধরে এনেছিলেন আশেক এলাহী।
ভুক্তভোগীরা জানান, রাতের আঁধারে বন্দরবাজার ফাঁড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে নিরীহ মানুষকে ধরে আনতেন এএসআই আশেক এলাহী। প্রথমে ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগে সিএনজিতে তুলে কৌশলে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতেন তিনি। এভাবে টাকা আদায় সম্ভব না হলে নিয়ে যেতেন ফাঁড়িতে। এরপরই শায়েস্তা করার দায়িত্ব পালন করতেন ইনচার্জ আকবর। প্রথমে চড়-থাপ্পড় দিয়ে অ্যাকশন শুরু হতো। চলতো টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত। শায়েস্তা করার প্রথম কাজটি করতেন এসআই আকবর নিজে। এরপরের দায়িত্ব পড়তো কনস্টেবল তৌহিদের কাছে। আকবর ডাক দেন তৌহিদকে। বলেন, ‘লাঠি নিয়ে আয়’। হুকুম পেতেই লাঠি নিয়ে হাজির তৌহিদ। লাঠি দিয়ে মক্কেলকে কয়েকটি আঘাত করতো তৌহিদ। এরপর একটি বিশেষ ধরণের চাকু নিয়ে আসলেন আরো এক কনস্টেবল। ধরিয়ে দিলেন মক্কেলের হাতে। তাতেই গল্প শুরু। টাকা দে, না হয় কোর্টে চালান করে দেয়া হবে বলে জানান তৌহিদ। পরে ওই ভুক্তভোগী ফোন করে পরিবারের সদস্যদের জানান। তারা টাকা নিয়ে যাওয়ার পর আটককৃত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়া হয় ফাঁড়ি থেকে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের নবাগত কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, রায়হান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার এসাইনমেন্ট নিয়েই আমি সিলেটে এসেছি। আমার নিজস্ব পরিকল্পনার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কিছু নির্দেশনাও রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, সব কিছু গোছানো সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, আকবরকে কেউ যদি মদদ দিয়ে থাকে সবাইকে শনাক্ত করা হবে। সম্পৃক্ততা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারাও মামলার আসামী হবেন। পলাতক এসআই আকবর প্রসঙ্গে নবাগত কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, পলাতক আকবরকে গ্রেফতারে সবাই চেষ্টা করছে, যতো দ্রুত সম্ভব সে গ্রেফতার হবে। তাকে গ্রেফতার করতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিট কাজ করছে।