কমলগঞ্জে সরকারি মামলা : গ্রেফতার আতঙ্কে ঘরে ঘরে তালা
কমলগঞ্জ সংবাদদাতা :
কমলগঞ্জ সংবাদদাতা : কমলগঞ্জে কয়েকটি বসতবাড়ি উচ্ছেদ করে গাছ কেটে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রায়ণ প্রকল্প কাজে প্রশাসনের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজকান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন রাতেই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর দায়েরকৃত মামলায় নিরীহদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশী গ্রেপ্তার আতঙ্কে কমলগঞ্জের রাজকান্দি এলাকার ঘরে ঘরে তালা ঝুলছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অধিকাংশ বাড়ির পুরুষরা বাড়ি ছাড়া। দিনের বেলায় হাতেগোনা কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেলেও রাতে সে সংখ্যা নেমে আসে শূন্যের কোটায়। কমলগঞ্জের এসিল্যান্ডের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার পর থেকে পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। উৎকন্ঠায় তাদের মানবেতর জীবন যাপন চলছে।
সরেজমিন রাজকান্দি গ্রাম ঘুরে জানা যায়, সম্প্রতি কমলগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজকান্দি এলাকার সরকারি খাসজমি বের করে ‘দুর্যোগসহনীয় গৃহনির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ‘আশ্রয়ণ-২’ প্রকল্পের ২০টি গৃহ নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। ১৬ নভেম্বর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সাইনবোর্ড স্থানীয়রা ভেঙে ফেলে। ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলার শিকার হন কমলগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন চৌধুরী। এ সময় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় এসিল্যান্ড নাসরিন চৌধুরী, নারী পুলিশ সদস্য সেলিনা আক্তারসহ ৩ জন আহত হন। এবং এসিল্যান্ড এর ব্যবহৃত সরকারি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনার পরপরই কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ। এদিকে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার দিন রাতে কমলগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়। সরকারি কাজে বাধা, হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে কমলগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরীন চৌধুরী বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় নারী-পুরুষ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৫৩-৫৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। মামলার পর ওইদিন রাতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৮ জন ও পরে আরো ২ জনসহ ১০ জনকে আটক করে পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত নয় তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) বিকালে সরজমিনে দেখা যায়, মামলার প্রধান আসামি সুন্দর মিয়ার বাড়িসহ ঘটনাস্থলের আশপাশের বাড়িগুলোতে কোনো মানুষ নেই। প্রতিটি বসতঘরে ঝুলছে তালা। গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ির পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো বাড়িতে পুরুষ থাকলেও হঠাৎ গাড়ির শব্দ পেলেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে নিরপরাধ অনেক মানুষও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে স্থানীয়রা জানান। ভূমিহীনদের জন্য সরকারের জনবান্ধব কর্মসূচী আশ্রায়ণ প্রকল্প কর্মসূচীর জন্য ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজকান্দি গ্রাম এলাকায় সরকারি খাস জমিতে প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে প্রকল্প গ্রহণকৃত ঐ স্থানে বসতবাড়ি নির্মাণ, ফলজ-বনজ গাছ রোপন, পানের বরজ রোপন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন প্রায় শতাধিক পরিবার। কয়েকটি বাড়ি উচ্ছেদ করে গাছ, বাঁশ কেটে প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিলে তাতে বাঁধা দেন এলাকাবাসী। এ সময়ে স্থানীয় কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির আক্রমণের শিকার হন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন চৌধুরী ও নারী পুলিশ সদস্য সেলিনা আক্তার। এসিল্যান্ডের ব্যবহৃত সরকারি গাড়ির একটি গ্লাসও ভেঙ্গে যায়। আহত নারী পুলিশ সদস্যকে মৌলভীবাজার সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন- আগের দিনেও গ্রামবাসী প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছে। আর উদ্বোধনের দিনে এমন হামলার ঘটনা প্রমাণ করে তৃতীয় কারো উস্কানি রয়েছে। তিনি আরও বলেন- মূল হামলাকারী সুন্দর মিয়া ঘটনার আগের দিন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমানের সাথে দেখা করলে চেয়ারম্যান আমার কাছে বিষয়টি জানতে চান। পরদিনই সুন্দর মিয়াসহ কতিপয় ব্যক্তিরা প্রশাসনের লোকদের উপর হামলা করে। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে নিরপরাধ কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখার জন্য প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান।
ইসলামপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সোলেমান মিয়া বলেন- সরকার তাঁর ভূমিতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এখানে আমার কোন লোকের বাঁধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে রহমান মিয়াসহ মহিলা ইউপি সদস্যরাই সরকারি ভূমি দখল করে রয়েছে।
কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন- ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে আটক করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এমন কাউকে পুলিশ আটক করবে না বলেও জানান ওসি। ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিরীহ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন- শুধুমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বটাই আমার। হামলা-মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
কমলগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন চৌধুরী জানান- ভূমি চিহ্নিত করার দিনেও স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করেছে। আশ্রায়ণ প্রকল্পের জন্য উদ্বোধনের দিনে তারা হামলা চালায়। এতে গাড়ির গ্লাস ভাঙে ও নারী পুলিশ সদস্য আহত হন। পরদিনের হামলার ঘটনায় কারো ইন্ধন থাকতে পারে মনে হচ্ছে। তবে ভিডিও ফুটেজ দেখে মামলায় প্রকৃত ব্যক্তিদেরই আসামী করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক মামলা ও আসামী গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন- বিষয়টি প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন খুবই গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখছে।