হিন্দুরা তো প্রতিবেশী, তাদের ঘর পুড়াবো কেন?
আব্দুল হাদী
আমার চলার পথে সাথী হিসেবে অনেক সময় থাকে হিন্দু, এছাড়াও রয়েছে একাধিক বন্ধু । হিন্দুরা তো আমাদের প্রতিবেশী, তাহলে তাদের ঘর কেমন করে পুড়াবো? কেনই বা দৌড়াবো না হয় ভেঙে ফেলবো তাদের মন্দির! বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্নটা অনেক ঘুরপাক খাচ্ছে। সঙ্গহীন এবং বন্ধুত্ব নষ্ট করার লক্ষ্যে তৃতীয় কোন পক্ষ কি কাজ করছে? সাথী কিংবা কোন বন্ধুকে তো কখনো সংখ্যালঘু বলে হেয় প্রতিপন্ন করিনি বরং সম্মান দিয়েছি নিজের ধর্মের মানুষের চাইতে বেশি। আমি যদি হিন্দুদের সাথে চলাফেরা করি তাহলে প্রায় প্রত্যেক মুসলমানই কোন না কোন হিন্দুর সাথে চলাফেরা করে। আমি একজন মুসলমান হিসেবে তাদের সাথে যে আচরণ করি অন্যরাও নিশ্চয় এমনটাই করবে।
‘কালীগঞ্জ বাজার’ এ নামটি কোন ধর্মের সাথে যায়, সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবেনা নিশ্চয়। এ নামের বাজারে আমার প্রতিদিন বসা হয়। যেখানটায় বসি, তার ডানে-বায়ে-সামনে হিন্দু ব্যবসায়ী। কাউকে তো কখনো হিন্দু বলে অশ্রদ্ধা করিনি। কিংবা স্থানীয় কোন মুসলিমকে দেখিনি তাদেরকে নির্যাতন করতে। তাদের ধর্মকর্মে কেউ কখনো বাধা দেয়নি। আমার আশেপাশে অনেক হিন্দু, তারা অবাধে চলাফেরা করছে। সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে। কই তাদের ঘর তো কেউ পুড়ায়নি, সংখ্যালঘু বলেও নির্যাতন করেনি। সাধারণত মানবন্ধন, মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা করা হয় অধিকার আদায়ের জন্য। আর দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষমতা রাখেন সরকারপ্রধান এবং তার সঙ্গী-সাথীরা। কুমিল্লার মুরাদনগরের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলায় হিন্দু এবং তাদের সাথে অন্যান্য ধর্মের সবাই মিলে প্রতিবাদ করছেন এবং বিচারের দাবী জানাচ্ছেন। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এটাই হলো মূল বিষয়। একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনের করায় মুসলমান কেউ তাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে না কিংবা তাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না।অপরাধী যারা তাদের বিচার হোক, এটা সব ধর্মের মানুষই চায়।
মুরাদনগরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো দেশজুড়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে দেয়ার কি কোন পায়তারা চলছে? শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে, ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। সেখানে কেউ মিছিলে স্লোগান ধরেনি একটা করে হিন্দু ধর -ধইরা ধইরা জবাই কর। বাংলাদেশের অমুক হিন্দুর দুনো গালে, জুতা মারো তালে তালে। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে ভাইরাল হওয়া একটি মিছিলের স্লোগানগুলো দেশকে ধর্মীয় সংঘর্ষের দিকে টেলে দিচ্ছে। যেমন, হেফাজতের দুনো গালে, জুতা মারো তালে তালে ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে কেন হচ্ছে? কী কারণে হচ্ছে? যারা হিন্দু নেতা তাদের একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তা না হলে বিচারের বদলে সংঘাতে রূপ নিতে পারে সুষ্ঠু মানবন্ধন আর প্রতিবাদ সভা সমাবেশ।
ফেইসবুক আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় । তবে এটাও জেনে রাখা ভালো, দেশের সবাই কিন্তু এখনো ফেইসবুক চালায় না। আর যারা চালায় তাদের মধ্যে সবাই কিন্তু বুঝে না কোনটা গুজব আর কোনটা সত্য। মাথায় যদি শয়তানের বুদ্ধি থাকে, তাহলে যেকোনও মুহূর্তে ভার্চুয়াল জগতে গুজব ছড়িয়ে যে কাউকে ফাঁসানো যায়। ফেইসবুক বাদ দিয়ে বাস্তব ঘটনা বলি, নির্বাচনে ভোটের জন্য প্রার্থী রাতের আঁধারে তার সমর্থকদের দিয়ে পোস্টার ছেঁড়ায়। পরদিন সকালে অন্য প্রার্থীর উপর দোষ চাপায় এবং তাকে লোকের কাছে মন্দ বানিয়ে নিজের পক্ষে ভোট বাড়ায়। কিন্তু এটা যে কত বড় মিথ্যাচার ভোটাররা তা বুঝতে পারে না। তাই তাকে ভোট দেয়। সংখ্যালঘু কিন্তু মুসলমান কেউ বলে না, হিন্দুরাই নিজেদের সংখ্যালঘু বলে। তারা নিজেরা নিজেদের সবল করতে গিয়ে এরকম কিছু করছে না তো? কেননা রাতের আঁধারের চাইতে ভার্চুয়াল জগতের আধার বেশি ভয়ঙ্কর।
যে কোন জায়গায় বসে যে কেউ ফেইসবুক চালাতে পারে। আর ফেইসবুক দিয়ে এখন যার যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। যেমন, বোদাই ফেইসবুক চালাতে খুব দক্ষ। নিজের নামে ফেইসবুক আছে এবার শখ হয়েছে মেয়েদের নামে একটা ফেইসবুক বানাবে । ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ হলো, বুদাই হলো বুদিনি। এবার বুদিনিকে মেয়ে জেনে একাধিক ছেলে প্রেমের ফাঁদে পড়ে গেলো। শুধু প্রেম নয় অনেক আদান প্রদান হয়ে গেলো। কিন্তু তারা জানে না, এটা বুদাই’র ফেইসবুক। উদাহরণটা বেশ দুর্বল, এর চাইতে আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে ফেইসবুকে। ধরেন দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তাই একে অপরে ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে জীবনের সব পাসওয়ার্ড জানে। কিছুদিন পর তাদের বন্ধুত্ব নেই, একে অপরের শত্রু হয়ে গেলো। এখন ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড দিয়ে কি ঘটাতে পারবে? যে যেভাবে চাইবে সেভাবেই গুজব রটিয়ে সংঘর্ষ বাধাতে পারবে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংঘাতের জন্য দায়ী হয়ে উঠছে ফেইসবুক এটা আমাদের বুঝে নেয়া প্রয়োজন।
সরকার অতি সহজে কোন আন্দোলনের পক্ষে সায় দেয় না। সেখানে অনেক হিশেবনিকেষ থেকে যায়। তা যে কোনও সরকারই হোক। এ দেশে সরকারের পালাবদলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানরা কখনো সুবিধাবঞ্চিত হয়নি। তাই কুমিল্লার ঘটনার জন্য সরকার তাদের কর্মকর্তা দিয়ে সুষ্ঠ বিচার সম্পন্ন করবে অবশ্যই। কিন্তু এর আগে হিন্দুধর্মের যারা অভিভাবক রয়েছেন তাদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন যারা ধরে ধরে জবাই করতে চায় তারা কারা এবং কেন জবাই করতে চায়। তাদের পেছনে মদদদাতা কারা? এরকম স্লোগান সংঘাতের দিকে নিয়ে গেলে দেশের পুরো হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্থ ছাড়া লাভবান হবেন না হয়তো। অপরদিকে দেশের মুসলমান যারা তারা হুট করে এর প্রতিবাদে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়া সমীচিন নয়। ভার্চুয়াল জগতে উস্কানী দিয়ে জাতিকে সংঘাতের দিকে না নেয়াটাই ভালো। ছোট্ট একটা গোষ্ঠী হয়তো আছে, যারা ইহুদি এবং ভারতের দালালী করে। তারাই বিভিন্নভাবে উস্কানি দিয়ে দেশে ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি করে দেশটাকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানিয়ে প্রচার করতে চায় তাদের প্রভূদের কাছে।
উদাহরণস্বরূপ একটি গল্প, এক গ্রামে ৮০টি হিন্দু পরিবার এবং ১২টি মুসলিম পরিবারের বসবাস। হিন্দু-মুসলিম মিলে এক পঞ্চায়েত। হঠাৎ দুই হিন্দু পরিবারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলো। বিরোধ নিস্পত্তির লক্ষ্যে পঞ্চায়েতের বিচার হলো। পঞ্চায়েতের বিচারকার্যে একটি পরিবারকে অন্যায় হিসেবে নির্ধারণ করা হলো । কিন্তু সে অন্যায় করেছে সেটা মানতে রাজি নয় বরং উল্টো অপর হিন্দু পরিবারের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। সেই সংঘর্ষে ন্যায় পক্ষের সাথে মুসলিম ২টি পরিবারের লোকজন আহত হলো। এবার গ্রামে থাকা ১২টি মুসলিম পরিবার অন্যায়কারী হিন্দু পরিবারের প্রতি ক্ষেপে গেলো। তাদের সাথে পাশের গ্রামের মুসলিমরা এসে যোগ দিলো। অন্যায়কারীদের ভালোভাবে শায়েস্তা করা হলো। কিন্তু হিন্দু একটি পরিবারের পক্ষে মুসলমানরা এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও সেই ঘটনা অন্য ভাবে রটে গেলো। গুজব রটলো মুসলমানরা হিন্দুদের নির্যাতন করেছে। বিষয়টা অনেক আলোচনা সমালোচনার পর সমাধান হয়েছে কিন্তু ঐ ১২টি পরিবারের কেউ আর হিন্দুদের সাথে একই পঞ্চায়েতে না থেকে পাশের গ্রামের পঞ্চায়েতের সাথে মিলতে বাধ্য হলেন।
প্রতিবেশী সংখ্যায় কম কিন্তু তাদের আচার আচরণ খুব খারাপ। এর প্রতিবাদ যদি সংখ্যায় বেশি থাকা প্রতিবেশী করে তাহলে দূরের লোকেরা বলবে ওরা সংখ্যায় আর শক্তিতে কম তাই তাদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে। কিন্তু ভেতরের খবর কেউ নেবে না। ঘটনা যা ঘটে তা সঠিকভাবে প্রচার করলে তার সমাধান হয় সহজে। আর তিলকে তাল বানিয়ে রটালে দেশ এবং দশের ক্ষতি সাধন হয়। উপসংহার প্রয়োজন, তাই বলি দেশের সব হিন্দুরা যদি মিছিল দেয় একটা করে মুসলমান ধর, ধরে ধরে জবাই করো। এটা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ সংখ্যায় পোষাবে না, মুসলমান তো বেশি। জবাই করার আগেতো অন্য কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এরকম অবস্থার সৃষ্টি হলে আমার আপনার চলার সাথী, বন্ধু, প্রতিবেশী হিন্দু তারা কোথায় যাবে? আমি কেবল হিন্দু মুসলমানকে ধরে এনে এক জায়গায় হ্যান্ডশিপ করাতে চেয়েছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি… হিন্দু মুসলমানে দিন রাত হানাহানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ-যুদ্ধ-বিগ্রহ! কাজী নজরুল ইসলামের যদি আর বাঁশি না বাজে কবিতার লাইনগুলো প্রমাণ দেয় এ দেশে হিন্দু মুসলমানের সংঘাত অনেক আগের। কিন্তু সে সংঘাত প্রায় থেমে গেছে। বর্তমান সময়ে যদি সংঘাতের সৃষ্টি হয় তাহলে এর দায় হিন্দুদের নিতে হবে।
বর্তমানে ভার্চুয়াল জগতটা খুবই পিচ্ছিল। বিশেষ করে ধর্মের ব্যাপারে। বাঙালীর কাছে ভার্চুয়াল জগতটাকে এখনো একেবার নতুন বলেই মনে হচ্ছে। কেননা ঘরে একা বসে একটি মেয়ে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে ভালো নাচ গান করতে পারলে সে দুনিয়ার সেরা নাচনেওয়ালী বনে যেতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে কোনও হিন্দু একা ঘরে বসে কোন হিন্দুর ফেইসবুক পাসওয়ার্ড চুরি করে সেখানে ইসলাম ধর্ম নিয়ে খারাপ মন্তব্য করে দিতে পারে। আর এতে ঐ হিন্দুর উপর মুসলমানরা ক্ষেপে গিয়ে সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও অতি উৎসাহী কোন মুসলমান ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে ভাইরাল করার জন্য হিন্দু সেজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে। এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করা বন্ধ করতে হবে। ধর্ম, দেশ, জাতি সবকিছুর দিকে খেয়াল রেখেই পথ চলতে হবে, কেননা এখন সংঘাতের সময় নয়। কেবল ভালোবাসা দিয়ে একে অপরের মন জয় করে নেওয়াই ভালো।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।
[বি.দ্র. : মুক্ত কথন বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে ‘দৈনিক সময় সিলেট’ এর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। ‘দৈনিক সময় সিলেট’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তকথনে প্রকাশিত লেখার দায় ‘দৈনিক সময় সিলেট’ নয়।]