মেডিকেলে চান্স পেয়েও কেন তাঁরা দুশ্চিন্তায়?
নাদিম মাহমুদ
ভ্যানে করে গাছ বিক্রির উপার্জিত অর্থে পড়াশোনা চালিয়ে এবার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের তাজগীর হোসেন। মাতৃহারা তাজগীর যখন চিকিৎসক হওয়ার পথে, ঠিক তখনই ভর্তি হওয়ার কয়েক হাজার টাকার অভাবে শঙ্কায় পড়েছেন তিনি।
শুধু তাজগীর নন, প্রথম আলোর প্রকাশিত খবরগুলো বলছে— এবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামের জেলেপল্লির মেয়ে মারুফা, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের ধলজান গ্রামের সাধনা, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর গ্রামের সবুজ, গাইবান্ধার প্রতীক কুমার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবদুল্লাহ্, ঠাকুরগাঁওয়ের আলপনা, বরিশালের বানারীপাড়ার সাদিয়া এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেলেও তাজগীরে পথের সহযাত্রী তাঁরাও।
তাঁরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেলেও দারিদ্র্য তাঁদের সবার সঙ্গী হয়ে আছে। অঁদের কারও বাবা জেলে, কেউ হোটেলশ্রমিক, রিকশাচালক, কেউ সবজি বিক্রেতা আবার কেউ ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করে সন্তানদের সামনে এগিয়ে নিয়েছেন। এই দারিদ্র্যজয়ীরা ১২ বছর ধরে সংগ্রামের মধ্যে এগিয়ে এলেও এবার যেন থমকে বসছেন তাঁরা। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁদের মা–বাবা। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নকে ধরতে গিয়ে মেডিকেল ভর্তির জন্য কয়েক হাজার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর তাই পত্রপত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়ে সমাজের উচ্চবিত্তদের দৃষ্টিতে পড়তে হয়।
বিষয়টি শুধু এ বছরের নয়। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার পর দেশের আনাচে-কানাচে দরিদ্রগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি নিয়ে শঙ্কায় থাকেন। মোটা অঙ্কের অর্থ জোগাড় যে পরিবারগুলোর জন্য কষ্টসাধ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, আমাদের এই ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর স্নাতক হওয়ার আগপর্যন্ত সর্বোচ্চ বিশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন, পরীক্ষা ফি ও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিতে হয়। অথচ দেখুন, এসব শিক্ষার্থীর জন্য সরকার বার্ষিক এক থেকে তিন লাখ টাকা ব্যয় করে যাচ্ছে। ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের পেছনে আমাদের রাষ্ট্র যে খরচ করে, সেটি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে, যা উন্নত দেশগুলোয় বিরল।
এই যে আজ সাধনা, সবুজ, মারুফা কিংবা প্রতীক ভর্তির টাকার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন, তাতে হয়তো পত্রিকায় শিরোনাম হওয়ার প্রেক্ষিতে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। কিন্তু যাঁরা শিরোনাম হননি, যাঁদের কথা আমরা আজও জানি না, যাঁদের দারিদ্র্যের গভীরতা আমাদের কর্ণকুহুর ভেদ করেনি, তাঁরা কী করবেন? তাঁরা কি এই অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারবেন না? ঠিক প্রতিবছর কত ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চান্স পাওয়ার পরও ভর্তি হতে পারেননি? এই পরিসংখ্যান হয়তো আমরা জানি না, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যে মা–বাবা তাঁদের সন্তানকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, সেই মা–বাবারা ধারদেনা করে হলেও তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করাবেন। নিজেদের গরু-ছাগল, গাছ বিক্রি করে হলেও তাঁরা ভর্তি হবেন। আর ভর্তির পর, সেই দারিদ্র্যমাখা ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করা অবস্থায় উল্টো মা–বাবাকে খরচ দেবেন। সেটি সম্ভব হয় টিউশনির মাধ্যমে, স্বল্প সময়ের চাকরির সুবাদে। আর এই চিত্র আবহমানকাল ধরে চলে আসছে।
আমাদের রাষ্ট্র ভর্তির পর তাঁদের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে পারলে, ভর্তিতে কেন এই গুটিকয় শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াবে না? কেন তাঁদের ভর্তি ফি মওকুফ করা যাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-কল্যাণ পরিষদ থেকে গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির পর অর্থসহায়তা দিতে পারলে, কেন মারুফা-সাদিয়াদের ‘শূন্য অর্থে’ ভর্তির ব্যবস্থা করতে পারবে না? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো/কলেজগুলোর কি সেই সক্ষমতা নেই?
বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আমি মনে করি, পত্রপত্রিকায় এ ধরনের সংবাদ বন্ধ হবে না। প্রতিবছর আমাদের গণমাধ্যমে এ ধরনের সংবাদ আসবে, কেউ কেউ তা পড়ে আবার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবেন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরগুলোর মন্তব্যে অনেকেই সেই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু কেন শিক্ষার্থীরা এই শঙ্কায় পড়বেন? আমাদের রাষ্ট্র ভর্তির পর তাঁদের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে পারলে, ভর্তিতে কেন এই গুটিকয় শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াবে না? কেন তাঁদের ভর্তি ফি মওকুফ করা যাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-কল্যাণ পরিষদ থেকে গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির পর অর্থসহায়তা দিতে পারলে, কেন মারুফা-সাদিয়াদের ‘শূন্য অর্থে’ ভর্তির ব্যবস্থা করতে পারবে না? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো/কলেজগুলোর কি সেই সক্ষমতা নেই?
আপনি যদি চার হাজার মেডিকেলে ভর্তিযোগ্য এসব শিক্ষার্থীর খোঁজ নেন, দেখবেন অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরিবার আর্থিকভাবে শক্ত-পোক্ত। নানার সুবিধার মধ্যে বেড়ে ওঠা সেসব শিক্ষার্থীর কাতারে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করা অর্থে সাধনা কিংবা হাটবাজারে সবজি বিক্রি করা অর্থে সবুজের দাঁড়ানো যে কতটা কষ্টের, কতটা প্রতিকূল, তা যাঁরা এমন পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। এই যে ঢাকায় যেসব সাহেব দেশটাকে পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন, যাঁরা আজ সরকারি গাড়ি-বাড়িতে থাকছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনো সময় এই সবুজ-সাধনার পরিবারের মতো ছিল। সংসারের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো যখন প্রতিষ্ঠা পেয়ে সবুজ–মারুফাদের দায়িত্বটুকু নিতে চান না, তখন আমাদের রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। এই রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায়। সেই হাওয়া হয়ে যাওয়া অর্থের কিঞ্চিৎ অংশ এই দারিদ্র্যজয়ী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য সরকারের সদিচ্ছায় যথেষ্ট।
সরকারের উচিত হবে— যেসব দরিদ্র ঘরের সন্তান ভর্তির খরচ জোগাতে পারবেন না, তাঁদের ভর্তির যাবতীয় ফি মওকুফ করে দিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা। শুধু ভর্তির ব্যবস্থা নয়, স্নাতক শেষ করা পর্যন্ত এসব ছেলেমেয়ের পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারবে, তাতে আমার বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই।
রাষ্ট্র যদি সে ব্যবস্থা না–ও করতে পারে, তাহলে আমাদের মেডিকেল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে, বিনা সুদে ঋণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যবস্থা করা। যেন এসব শিক্ষার্থী ভর্তির পর পরবর্তী চার বা পাঁচ বছরে সেই অর্থ পরিশোধ করতে পারেন। যেসব ছেলেমেয়েকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে তাঁদের শিক্ষকেরা বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন, তাঁদের সুখ-দুঃখে সঙ্গী হয়ে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন, তাঁদের জন্য আপনাদেরও দায়বদ্ধতা থাকে।
বর্তমানে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে দেশের বেশ কিছু ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান কেবল ভর্তির পর প্রাপ্ত কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে, বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করে। এই উদার গোষ্ঠীও চাইলে আলপনা, তাজগীরদের ভর্তির দায়িত্ব নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে, কলেজগুলোকে তাঁরা ভর্তির আগেই নোটিশ দিয়ে বলতে পারে— ‘যেসব গরিব ছেলেমেয়ে ভর্তি হতে অর্থ প্রদান করতে পারবেন না, তাঁদের উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে ভর্তি করিয়ে নেন, যার অর্থ ওই সব পৃষ্ঠপোষক ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান তাঁদের বৃত্তির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ব্যবস্থা করতে পারে।’
আমাদের মতো একটি গরিব দেশে, সীমাহীন বাধা–বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে চলা এসব সংগ্রামী ছেলেমেয়েদের রুখে দেওয়ার শক্তি কারও নেই। তবে ভর্তির জন্য সামান্য কিছু অর্থের জন্য অন্যের দ্বারে ঘুরবে, তা সত্যি মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সমাজের উচ্চবৃত্তি ক্রমেই যখন বাড়ছে, তখন গুটিকয় এই বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ার সক্ষমতা অনেকেরই রয়েছে।
দেশের অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, অনেক মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যালামনাই সংগঠন রয়েছে, তারাও বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। আমার মনে হয়— এসব অ্যালামনাইর উচিত, যেসব ছেলেমেয়ে এ ধরনের দারিদ্র্য জয় করে এগিয়ে এসেছে, তাঁদের এই ক্ষুদ্র সংকট নিরসন করা। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের পর একটি নোটিশ দিতে পারে—যেসব গরিব ছেলেমেয়ে ভর্তি হতে পারছেন না, তাঁদের ভর্তির খরচ তারা বহন করবে।
দেশের বাইরে হলে, এসব ছেলেমেয়ে নিজেদের পড়াশোনার খরচ নিজেরাই পার্ট টাইম কাজ করে জোগাড় করতে পারতেন। এমনকি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় চাকরি করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর সুযোগও রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের সুযোগ কম থাকায়, আজ তাঁরা পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছেন। অন্যের সহায়তার জন্য ধরনা দিচ্ছেন। সম্প্রতি দেশের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা করা অবস্থায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের সুযোগ পাবেন।
আমার ধারণা, সাধনা, তাজগীররা যখন মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করবেন, তাঁদের মেরুদণ্ডের মজ্জাকে আরও শক্তিশালী করতে, তাঁদের জন্য পার্ট টাইম কাজের সুযোগ করে দিতে পারে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো। মেডিকেল কলেজের ভেতরেও।
এ তো কেবল কিছু প্রস্তাব। আমরা চাইলে অনায়াস এই কয়েক ডজন দারিদ্র্যজয়ীর সামনের পথ কণ্টকমুক্ত করতে পারি। এই সদিচ্ছা যদি তৈরি হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের পত্রিকায় এসব শিরোনাম দেখতে হবে না। কেউ আর ভর্তির টাকার জন্য আফসোস করবেন না। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক : ড. নাদিম মাহমুদ, গবেষক- ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। nadim.ru@gmail.com
বি.দ্র. মুক্তকথন বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে দৈনিক সময়সিলেট—এর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। দৈনিক সময়সিলেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তকথনে প্রকাশিত লেখার দায় দৈনিক সময়সিলেট—এর নয়।