বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশ : জয় হোক জয় হোক
মো. সেলিম আহমেদ
মো. সেলিম আহমেদ : বিজয় এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। অনেক জীবন ও স্বপ্নের বিনিময়ে। অনেক আশা ও সাধনার উচ্ছ্বাসে। বিজয়ের কথা যখন স্মরণ করি তখনই অনুধাবনে আসে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় ছিল এ জাতির চার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমুদ্রসৈকতে বালুকারাশির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রত্নভাণ্ডার সমুদ্রের বেলাভূমিতে, সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনী বাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালী দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এ প্রক্রিয়ার শুরু কখন তা কেউ জানি না বটে, ইতিহাসবিদদের ধারণায় কিন্তু এ জনপদে মানুষের বসবাস শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার বছরেরও আগে। ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম অথবা মধ্য ভারতের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সাথে, যদিও এ জনপদ দীর্ঘ দিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম এ জনপদ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং এর শাসন-প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই সন্তানেরা। এ কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় এ জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি মাইলফলক। একটি নতুন স্বপ্নের জন্মকাহিনী।
দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে, ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বতর্মান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমপের্ণর মধ্যে দিয়ে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অজর্ন চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বিজয়ের অনুভূতি সবসময়ই আনন্দের। তবে একই সঙ্গে দিনটি বেদনারও। স্বাধীন বাঙালি জাতি আজ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৯তম বাষির্কীতে পালনের মাধ্যমে ৫০ তম বর্ষে উপনীত। আজকের দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের। কোন স্বপ্ন ও চেতনা ধারণ করে গোটা দেশের আপামর জনগণ জেগে উঠেছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর শুরু করা গণহত্যা রুখে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, লাখো মানুষ নিঃশেষে জীবনদান করেছিল- সেই চেতনাকে উপলব্ধি করতে হবে, লালন করতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত করতে হবে। আনুষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বে বিজয় দিবস পালনের সাথর্কতাই এখানে। আজ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র স্মৃতি। স্মরণ করি বীরাঙ্গনাদের, যারা চরম মূল্য দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা স্মরণ করি স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি শহীদ চার জাতীয় নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী সরকারের নেতাদের। আমরা স্মরণ করি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে জীবনদানকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের; কৃতজ্ঞতা জানাই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দসহ আন্তজার্তিক অঙ্গনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব সরকারি-বেসরকারি বন্ধুর প্রতি।
যে হিংস্রতা ও ববর্রতার সঙ্গে দখলদার বাহিনী ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পযর্ন্ত অল্প সময়ে ব্যাপক গণহত্যা, নারী ধষর্ণ, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং যে সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে দেশের আপামর মানুষ প্রতিরোধ ও লড়াই গড়ে তুলেছে, তার সমকক্ষ নজির ইতিহাসে বিরল। দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল আবর্তে পড়ে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়নি। এটা আমাদের একটি মমের্বদনা। ইতিহাসের এই দায় পরিশোধে ভবিষ্যতে হয়তো উদ্যোগ গৃহীত হবে। পাকিস্তান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চুক্তিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও সে দায় এড়িয়ে চলছে। আবার দেশবিরোধী নানা অপশক্তির কারণে এখনো নানাভাবে রক্তাক্ত হচ্ছে বাংলার জনপদ। একটি স্বাধীন দেশ এ অবস্থায় চলতে পারে না বিধায় সব ধরনের অপশক্তির মূলোৎপাটনে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের শপথও ছিল তার মধ্যে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা- এসব ক্ষেত্রে বলতে গেলে এখনো আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি। আবার একথাও ঠিক যে, বাংলাদেশ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে। মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ এতদিন যে অমিত সম্ভাবনা, আশা ও স্বপ্ন লালন করেছে, বতর্মান সরকারের হাত ধরে দেশটির অগ্রগতি ও উত্তরণ সত্যিই বিস্ময়কর। তবে এখনো আমাদের পুরোপুরি অথৈর্নতিক মুক্তি আসেনি। এখন অথৈর্নতিক মুক্তির লক্ষ্যেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজয় আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। স্বাধীনভাবে বিকাশের সুযোগ পাওয়ার জন্যই আজ অথৈর্নতিক উন্নয়নের চেষ্টা, পোশাকশিল্প বা ক্রিকেট খেলা বা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কাযর্ক্রম বা অভিবাসী কমর্শক্তি ইত্যাদি একাধিক ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ একটি নাম। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্তা, শিশুমৃত্যু কমানো ও শিশুশিক্ষা বাড়ানো, প্রতিকূল অবস্থায়ও অথৈর্নতিক প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া- গৌরবের বিষয়। পদ্মা সেতু, কণর্ফুলী টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দর, নগরে মেট্রো রেল ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেক বড় প্রকল্প চলমান। বলা যায়, দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। সবোর্পরি বলতে চাই, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অথৈর্নতিক উন্নয়ন যদি সামঞ্জস্যপূণর্ভাবে অগ্রসর হয় তাহলে ২০৪১ সালের আগেই সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বাংলাদেশ উন্নত অথৈর্নতিক, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন ও শত্রুমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হোক, প্রতিটি হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অম্লান থাকুক নিখুঁতভাবে- এমনটি প্রত্যাশা হৃদয়ের। জয় হোক জয় হোক, বাংলাদেশের জয় হোক।
লেখক : চেয়ারম্যান- দৈনিক সময় সিলেট ও এসএমএস মিডিয়া লিমিটেড, সিলেট।