আমেরিকার গণতান্ত্রিক ইতিহাসের কালোতম দিন
ফকির ইলিয়াস
০৬ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার। প্রতিদিনের মতো কোলাহলমুখর নিউইয়র্কের দিন। অফিসপাড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য এই মহামারীকালে যথাসাধ্য দিন গুজরানের চেষ্টায় ব্যস্ত। দুপুর ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ করেই সংবাদ রটে যায়, ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল হিল দখলের চেষ্টা করছে ট্রাম্প সমর্থকরা! এটা কেমন সংবাদ!
নিরাপত্তাবাহিনী কোথায়! টিভি, ফোন, প্রাইভেট মনিটরগুলো সচল হয়ে ওঠে একসঙ্গে। আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কী হচ্ছে তা দেখা কিংবা জানার জন্য। এরপরের ঘটনা খুবই ভয়াবহ। হাজার হাজার লোকের সমাবেশে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেরিয়ে এলেন। তিনি নিজকণ্ঠে বললেন- ‘এই নির্বাচন আমরা মানি না। আমাদের জয় ছিনতাই করা হয়েছে। আমরা শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব।’
তার ঘোষণার পরপরই মানুষ মারমুখো হয়ে ওঠে। তারা দখল করার চেষ্টা করে বিভিন্ন স্থাপনা। মই দিয়ে বিভিন্ন ভবনের ছাদে উঠে পড়ে। ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। যা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করার মতো মারাত্মক অপরাধ।
একজনকে দেখা যায়, স্পিকার ন্যান্সি প্যালোসির চেয়ারে বসে ঘোষণা দিচ্ছেন- ‘আমিই স্পিকার। ঘোষণা দিচ্ছি, ডোনাল্ড ট্রাম্পই আজীবন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট!’ ক্যাপিটল হিলে যা ঘটেছে, তা আমেরিকার ইতিহাসে তো বটেই গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি কালোতম দিন।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন- দিনটি পার্ল হারবার, কিংবা নাইন ইলেভেনের মতোই আমেরিকায় স্মরণ করা হবে একদিন! পুরো আমেরিকা এখন ভিত। মানুষ ঘৃণা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই সময়ে আরেকটি খবর এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ইরাকের একটি আদালত। গত বছরের জানুয়ারিতে ইরাকি মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদি আল-মুহান্দিসকে ড্রোন হামলায় হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এই পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গত বছরের ৩ জানুয়ারি বাগদাদ বিমানবন্দরের বাইরে হাশদ আল-শাবি গোষ্ঠীর উপপ্রধান মুহান্দিস মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। একই ধরনের হামলায় নিহত হন ইরানের বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানি।
এ হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই হত্যাকাণ্ডের পর ট্রাম্প বলেছিলেন- প্রধান শত্রুকে আমরা শেষ করেছি। এর আগে গত বছরের জুনে ইরানের একটি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার (ইন্টারপোল) কাছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রেড নোটিস দিতে অনুরোধ জানানো হয়। বিচার বিভাগের বরাত দিয়ে ফ্রান্স২৪ জানায়- ইরাকের দন্ডবিধি ৪০৬ ধারা অনুযায়ী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এই ধারায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় যে ট্রাম্পের কিছুই হবে না, হওয়ার নয়- তা সকলেই জানেন ও বোঝেন।
তবে ০৬ জানুয়ারির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে বলেই জানিয়েছে মার্কিনি আইন ও বিচার বিভাগ। নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে- প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্যাপিটল হিলে সহিংস হামলার ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হলে তা মার্কিন মামলা হিসেবে গ্রহণ করবে মার্কিন বিচার বিভাগ।
৭ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের আইএস অ্যাটর্নি মাইকেল শেরউইন এই তথ্য জানিয়েছেন। শেরউইন সাংবাদিকদের বলেছেন- ‘হামলায় যারা অংশ নিয়েছিল শুধু তাদেরই নয়, জড়িত সবার উপরেই নজর রাখছি।’
এর আগে হোয়াইট হাউসের সামনে এক জনসভায় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প বলেছিলেন- ‘শক্তি প্রয়োগ না করলে তারা কখনই দেশকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না।’ নির্বাচনের অনিয়ম হয়েছে বলে ট্রাম্পের ভিত্তিহীন দাবিতে প্ররোচিত হয়েই তার সমর্থকরা কংগ্রেসে জড়ো হয়েছিল ও জো বাইডেন জুনিয়রকে ইলেক্টোরাল কলেজের স্বীকৃতি পেতে বাধা দিতে চেয়েছিল।
এ কারণে ট্রাম্পকেও এই হামলার জন্য অভিযুক্ত করা হবে কিনা, শেরউইনকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন- ‘আমরা জড়িত সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেব। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনা হবে।’ একই দিনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ট্রাম্পকে দোষারোপ করে বলেছেন, ‘নির্বাচনে ভোট দেওয়া প্রায় ১৬ কোটি আমেরিকানের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার জন্য তিনি তার সমর্থকদের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়াসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে ইতোপূর্বে। এসব মামলা আবার জেগে ওঠে তাকে ঘায়েল করবে কিনা, ভাবনায় অস্থির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
সিএনএন একটি রিপোর্টে বলেছে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজেকেও ক্ষমা করার ক্ষমতা রাখেন কিনা, এখন পরামর্শক আর আইনজীবীদের কাছে জানতে চাইছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট। ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে যাদের বিভিন্ন অভিযোগে সাজা হয়েছিল, তাদের অনেককেই মেয়াদের শেষ বেলায় এসে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ক্ষমা করে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সিএনএন এক প্রতিবেদনে বলেছে- হোয়াইট হাউজের কাউন্সেল প্যাট সিপোলোনেকেও একই প্রশ্ন করেছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আইনজীবীদের সঙ্গে এ বিষয়ে তার কিছু আলোচনা হয়েছে। অবশ্য ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্যাপিটল ভবনে তার সমর্থকদের হামলা বা জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেটকে ভোটের ফল উল্টো দেওয়ার পথ খোঁজার জন্য চাপ দেওয়ার কথা ফাঁস হওয়ার পর দায়মুক্তির আলোচনা জোর পেয়েছে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এ ধরনের আলোচনা সম্পর্কে অবগত- এমন কয়েকজনের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস এর আগে খবর দিয়েছিল, নিজেকে ক্ষমা করার ওই আইডিয়া নিয়ে নির্বাচনের সময় থেকেই চিন্তাভাবনা করে আসছেন ট্রাম্প।
২০১৮ সালে একবার টুইট করে ট্রাম্প নিজেও বলেছিলেন- ‘বহু আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, নিজেকে ক্ষমা করার পূর্ণ ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু কেন সেটা করতে যাব, যখন আমি কোনো ভুল কোথাও করিনি!’ বিচার বিভাগের একটি লিগ্যাল মেমোতে বলা হয়েছে- প্রেসিডেন্ট নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। তবে তিনি পদত্যাগ করে ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে পারেন এবং তার কাছে ক্ষমার আবেদন করতে পারেন। তবে সেই লিগ্যাল মেমোও চূড়ান্ত কিছু নয় বলেও রিপোর্টে লিখেছে সিএনএন। একজন মানুষ কতটা সন্দিহান হলে এমন ভাবনা ভাবতে পারেন- সেই আলোচনায় মুখর এখন আমেরিকার রাজনীতি।
বিশেষ করে ০৬ জানুয়ারির উসকানির পর, বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে কী কী আইনি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে- বিস্তর ভাবছেন আইনজীবীরা। এই ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, আমেরিকার ‘আইনঘর’ কতটা অরক্ষিত! কেন এমনটি হলো? যে আমেরিকা গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলে, হুমকি দেয়- সেই আমেরিকার নিরাপত্তা কেন এমন নড়বড়ে? ক্যাপিটল হিল যখন আক্রান্ত, তখন হাউস মেজরিটি লিডার স্টেনি হয়ের, ম্যারিল্যান্ডের গভর্নর ল্যারি হোগান’কে কল করে বলেন- আমাদের সাহায্য করুন! আপনি ন্যাশনাল গার্ড পাঠান।
গভর্নর হোগান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন এসব কথা। হোগান জানিয়েছেন- কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে ৯০ মিনিট সময় লেগেছিল! এসব ঘটনার দেড় ঘণ্টা পরে ডিফেন্স সেক্রেটারি রয়ান ম্যাকার্তি ফোন করে গভর্নর হোগানকে ট্রুপস পাঠাতে বলেন। এর পরেই ম্যারিল্যান্ডের বাহিনী ডি সি’তে ঢুকে পড়ে। তারাই ছিল ওয়াশিংটনে বাইরের স্টেটের প্রথম কোনো বাহিনী। এবং তারা খুব দ্রুত পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেয়। হোগান জানিয়েছেন- ম্যারিল্যান্ডের চৌকস ন্যাশনাল গার্ড জানুয়ারি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত এই মিশনে থাকবে এবং ওয়াশিংটনে অবস্থান করবে।
ক্যাপিটল হিলে যা ঘটেছে, তা বিশ্বের যেকোনো সন্ত্রাসী ঘটনাকে হার মানিয়েছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়- ভিড় দেখে পুলিশ দ্রুত লাইন ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। দাঙ্গাকারীদের অনেকে বর্ম পরে ছিলেন। কারও কারও হাতে দেশি অস্ত্র, কারও হাতে রাসায়নিক স্প্রে ছিল। এসময় কী করছিল দায়িত্বে থাকা পুলিশ? এই প্রশ্নও আসছে।
মিডিয়াগুলো লিখছে- সন্ত্রাসীরা ভবনের ভিতর ঢুকে কয়েকঘণ্টা ধরে তান্ডব চালায়। তারপরও পুলিশকে তাদের ঘিরে ধরে ভবন থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করতে দেখা যায়। গ্রেফতার করার পরিবর্তে পুলিশ তাদের কাউকে কাউকে পথ দেখিয়ে ভবনের বাইরে নিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে এবং দরজা খুলতে সাহায্য করে। ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে ক্যাপিটল ভবনে ভাঙচুরের সময় এক পুলিশকে এক ব্যক্তির সঙ্গে ‘সেলফি’ তোলার জন্য পোজ দিতে দেখা যাচ্ছিল। ভাইরাল হওয়া আরেক ছবিতে এক বিক্ষোভকারীকে সগর্বে হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলসির ডেস্কে এক পা তুলে তার চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। পেলসির ডেস্ক থেকে একটি চিঠিও চুরি করেন তিনি।
এমন জঘন্যতম ঘটনায় আটকের সংখ্যা এত কম তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকেও আসল অপরাধীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরুর কথা জানানো হয়েছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন- দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বিরল ও গুরুতর অভিযোগ আনা হতে পারে। আর দোষী সাব্যস্ত হলে ২০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা হবে।
৬ জানুয়ারির রেশ ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকাজুড়ে। মানুষ ফুঁসছে। এই প্রেসিডেন্ট বিদায় নেবেন ২০ জানুয়ারি। এর মাত্র ক’দিন আগে কেন আমেরিকান গণতন্ত্রকে এমনভাবে কলুষিত করা হলো, এই প্রশ্ন আইন প্রণেতাদের তো বটেই, পুরো আমেরিকান জাতির। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতার জন্য অনেক ফন্দিফিকির করেছেন। কাজে আসেনি। কিন্তু তিনি এভাবে ভাঙচুরে উসকানি দেবেন- তা কাম্য ছিল না। গোটা বিশ্বের চোখ এখন ২০ জানুয়ারির দিকে। নতুন প্রেসিডেন্ট আসছেন। ট্রাম্প যুগের অবসান হবে বিশ্ব থেকে।
মানুষরা বলছেন- ট্রাম্প বিদায় নিলেই করোনাও নাকি বিদায় নিতে শুরু করবে পৃথিবী থেকে! এই প্রত্যাশাই সত্য হোক। কারণ মানুষ না বাঁচলে কার জন্য রাজনীতি! কীসের ক্ষমতার বড়াই!
লেখক : কবি, কলামনিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। oronik@aol.com
[বি.দ্র : মুক্তকথন বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে ‘দৈনিক সময় সিলেট’ এর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। ‘দৈনিক সময় সিলেট’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তকথনে প্রকাশিত লেখার দায় ‘দৈনিক সময় সিলেট’ এর নয়।]