বিশ্বনাথের এলাহাবাদ আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের এলাহাবাদ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসার (ইন নং- ১৩০২১০) অধ্যক্ষ আবু তাহির মোহাম্মদ হোসাইন একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি জামায়াত শিবিরের নাম ব্যবহার করেও ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেন। দুর্নীতি ঢাকতে প্রতিষ্ঠাতার পরিবার, শিক্ষক ও এলাকাবাসীকে নানাভাবে হয়রানী, হুমকি, ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আসছেন অধ্যক্ষ। ফলে দিনদিন মাদরাসার পরিবেশ ও উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ ও অর্থ আত্মসাতকারী হোসাইনকে অধ্যক্ষ পদ থেকে অপসারণ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষামন্ত্রী, মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
শনিবার (১৬ জানুয়ারি) সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ ও দাবি করেন ইউনিয়নের বাসিন্দা ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা পরিবারের সদস্য ফারুক আহমদ উল্লেখ করেন- এলাহাবাদ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা ১৯৭০ সালে সকলের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন আলেমেদ্বীন এটিএম ওলিউর রহমান। মাদরাসাটি ২০০৪ সালে আলিম পর্যায়ে উন্নীত হয়। ২০১৪ সালে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা এটিএম ওলিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তারই নিকটাত্মীয় তেলিকোনা গ্রামের বাসিন্দা আবু তাহির মোহাম্মদ হোসাইনকে অধ্যক্ষ নিয়োগ করেন। কিন্তু আবু তাহির হোসাইন ২৫ বছর ধরে মাদরাসাটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। রক্ষক এখন ভক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। ইচ্ছা মতো মাদরাসা পরিচালনা শুরু করে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও নানারূপ জাল জালিয়াতি, ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরী করে মাদরাসার অর্থ আত্মসাতের মহোৎসব শুরু করেন হোসাইন। তার এমন স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠাতার সহধর্মীনি ও গভর্নিং বডির সাবেক সভাপতি বেগম রাবেয়া আক্তার আপত্তি জানালেও কৌশল অবলম্বন করেন অধ্যক্ষ।
বক্তব্যে বলা হয়- মাদরাসা স্থানান্তরে এলাকাবাসীর সিদ্ধান্ত রয়েছে মর্মে বর্তমান সংসদ সদস্যের কাছ থেকে একটি ডিও লেটার নেন। পরবর্তীতিতে এমপি বিষয়টি জানতে পেরে ষড়যন্ত্রমূলক ডিও লেটারটি প্রত্যাহার করে নেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলার কারণে তেলিকোনা এলাহাবাদ আলিম মাদরাসায় উশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও মতামত দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এলাকাবাসী জানান- মাদরাসার নামে সরকারের রাজস্ব উন্নয়নের আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ তলা বিশিষ্ট ১ তলা একাডেমিক ভবন বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু অধ্যক্ষ মাদরাসার ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান।
তিনি ভবন নির্মাণ বাঁধগ্রস্থ করতে জেলা শিক্ষা অফিসকে ভূয়া তথ্য দিয়ে জানান- মাদরাসার ক্যম্পাসে পর্যাপ্ত জায়গা নেই। বিষয়টি মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতার ছোট ভাই মুখলিছুর রহমান জানতে পেরে গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের উপস্থিতিতে মাদরাসার জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করেন। এমনকি মাদরাসার নামে ৩৪ শতক জমি প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের পক্ষ থেকে রেজিস্ট্রিমূলে দান করা হয়। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বরাদ্দকৃত ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। অধ্যক্ষ যখন বুঝতে পারেন ভবন নির্মাণ বাঁধাগ্রস্থ করতে তার সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তখন মাদরাসার সকল নথিপত্র দিয়ে তার ভগ্নিপতিকে বাদী করে ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে সহকারী জজ আদালত বিশ্বনাথ সিলেটে একটি মামলা দায়ের করান। যার নং-২৪/২০২০। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।
এলাকাবাসী আরও জানান- অধ্যক্ষ পদে যোগদানের পর থেকে মাদরাসায় ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাট করে একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন হোসাইন। নিজের লোক দিয়ে গঠন করেন গভর্নিংবডি। শুধুমাত্র নিয়মানুযায়ী প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রীকে সভাপতি রাখলেও অন্যান্য সদস্য অধ্যক্ষের আজ্ঞাবহ হওয়ায় তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। মাদরাসার আয়-ব্যায়ের কোনো হিসাব তিনি গভর্নিংবডির নিকট প্রদান করেননি। তার এসব দুর্নীতি ও অর্থআত্মসাতের বিষয়ে মাদরাসার আজীবন দাতা সদস্য প্রবাসী আব্দুস সবুর ২০১৯ সালের ১২ মার্চ জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার গত বছরের ৫ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে আবু তাহির মো. হোসাইনের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ সত্য বলিয়া প্রমানিত হয়।
অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি জানতে পেরে অধ্যক্ষ তার কিছু আত্মীয়কে দিয়ে মাদরাসার বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে ‘জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসের হাত থেকে মাদরাসা রক্ষার’ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দায়ের করান। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইনচার্জ শামীম মুসা গত বছরের ২৬ জুলাই সিলেট জেলা পুলিশ সুপার বরাবর প্রতিবেদন দাখিল (স্মারক নং-১৭৬২) করেন। প্রতিবেদনে তিনি মাদরাসার বিষয়ে আনা সার্বিক অভিযোগ স্থানীয় গন্যমান্য লোকদের জিজ্ঞাসাবাদে মাদরাসায় জামায়াত-শিবিরের কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন। এতেও আবু তাহির মোহাম্মদ হোসাইন ক্ষান্ত হননি। তিনি বাদী হয়ে প্রতিষ্ঠাতার ছোট ভাই মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক মুখলিছুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় সাধারণ ডায়েরী (৫১৮) করেন। বিশ্বনাথ থানার সাব ইনস্পেক্টর মুহাম্মদ সাঈদুল ইসলাম গত বছরের ২৪ এপ্রিল সিনিয়র মাজেস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের নিকট অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে আবু তাহির মো. হোসাইন কর্তৃক আনিত অভিযোগ সত্য নয় মর্মে তিনি উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন- অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অর্থআত্মসাতের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের তদন্তে প্রমানিত হওয়ায় সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান গত গত বছরের ২৭ অক্টোবর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষামন্ত্রী বরাবর লিখিত (ডকেট নং- ৩৭২) সুপারিশ করেন।
বক্তব্যে এলাকাবাসী আরও উল্লেখ করেন- অধ্যক্ষ আবু তাহির মোহাম্মদ হোসাইন দীর্ঘদিন থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে মাদরাসার আয়-ব্যায়ের হিসাব না দিয়ে অর্থআত্মসাৎ করে চলছেন। তিনি এমপিওভুক্ত মাদরাসার অধ্যক্ষ হয়েও খাজাঞ্চী ইউনিয়নের কাজী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যা বিধি সম্মত নয় বলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের তদন্তে প্রমাণিত। মাদরাসার বর্তমান গভর্নিংবডির সভাপতি ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করলে শূন্যপদে অধ্যক্ষ তার নিজের আজ্ঞাবহ লোককে মনোনিত করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কোনো প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তিনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে সভাপতির প্যানেল জমা দেন। বিষয়টি এলাকাবাসী জানতে পেরে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে প্রেরিত প্যানেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড কারণ দর্শানোর জন্য অধ্যক্ষকে চিঠি দেয় এবং বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। উক্ত নির্দেশের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বনাথ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে অধ্যক্ষের অর্থআত্মসাৎ, দুর্নীতি ও সভাপতি মনোনয়নে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি প্রমানিত হওয়ায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যার স্মারক নং- USEO/বিশ্ব/সিল/৩০-২০২০/৭৯৪।
অনতিবিলম্বে দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষকে অপসারণ করে আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন এলাকাবাসী।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- বিশ্বনাথ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওয়াহিদ আলী, খাজাঞ্চী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুন নুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকাদ্দছ আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলকাছ আলী, বাদশাহ মিয়া, পীর শামছুল ইসলাম তোতা মিয়া, জবেদ আলী, আবুল লেইছ, জামাল উদ্দিন, তালিব উদ্দিন, আকলিছ হোসেন, আছকির আলী, মুজাহিদ আলী, মঈন উদ্দিন, আজিজুর রহমান, শাহ রফিকুল ইসলাম রাসেল, কদর উদ্দিন প্রমুখ।