শমশেরনগরে দৌড়প্রিয় মানুষের উচ্ছ্বাস : অংশ নিয়েছেন ৩০ বিদেশী
স্টাফ রিপোর্টার :
তখনো অন্ধকারে চারদিক ঢাকা। কনকনে হিম বাতাস আর কুয়াশা মোড়ানো একটি ফুটবল মাঠ। সেই মাঠে জড়ো হয়েছেন দেশ-বিদেশের একঝাঁক দৌড় পাগল নারী-পুরুষ। কেউ বয়সে তরুণ-তরুণী। অনেকেই আবার বয়স্ক। তবে উচ্ছ্বাসে সবাই সমানে সমান। পাহাড়ি পথে দৌড়ানোর জন্য এসেছেন তাঁরা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা-বাগান মাঠে ভোরের আগেই উৎসাহী মানুষের ভিড়ে জমে। কেউ মাঠে তাঁবু গেড়ে রাত্রিবাস করেছেন। কেউবা আশপাশের হোটেল বা স্বজনের বাড়িতে আগের রাতেই এসে উঠেছিলেন। শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) শমশেরনগর আলট্রা ট্রেল ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়। এটি আয়োজন করেছে শমশেরনগর রানার্স কমিউনিটি।
দৌড়ানোর জন্য ঢাকা থেকে এসেছেন আঞ্জুমান লায়লা নওশীন। রাতে তাঁবুর নিচে ছিলেন। তিনি বলেন- চা-বাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ানোর মজাটাই অন্য রকম। শিশির কণা ঝরছে। মাথায় মুক্তার দানার মতো জমছে, দারুণ অভিজ্ঞতা।
আয়োজক ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- তিন পর্যায়ের দূরত্বে এই ম্যারাথন দৌড় হয়। এর মধ্যে ছিল ১০ কিলোমিটার, ২১ কিলোমিটার ও ৫০ কিলোমিটার। সকাল সোয়া ৬টায় ৫০ কিলোমিটারে অংশগ্রহণকারী দলটি মাঠ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। পৌনে সাতটায় রওনা দেয় ২১ কিলোমিটারের দলটি এবং সোয়া সাতটায় রওনা দেয় ১০ কিলোমিটারের দলটি। ৫০ কিলোমিটারে অংশ নিয়েছেন ১৭৩ জন। ২১ কিলোমিটারে ২৬৫ জন ও ১০ কিলোমিটারে ১৮৫ জন। মাঠ থেকে রওনা দিয়েই চা-বাগানের উঁচু–নিচু পাহাড়ি পথে ছড়িয়ে পড়েন দৌড় প্রতিযোগীরা। নির্দেশিত পথে যাঁর যাঁর দূরত্ব অনুযায়ী, তাঁরা ছুটে চলেন।
বসুন্ধরা রানার্স গ্রুপের মিঠুন বিশ্বাস বলেন- ‘আমি ২১ কিলোমিটার দৌড়েছি। ট্রেল খুব ভালো ছিল। এ রকম ট্রেলে আগে দৌড়াইনি। খুব উপভোগ করেছি।’
চট্টগ্রামের নৃপেন চৌধুরী বলেন- ‘খুবই সুন্দর ট্রেল রুট। এই প্রথম ট্রেল ম্যারাথন উপভোগ করছি।’ নৃপেন চৌধুরীর বয়স ৬৯ বছর। ২০১৬ থেকে তিনি ম্যারাথনে অংশ নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে ৫০টি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন তিনি। আজকে অংশ নেন ২১ কিলোমিটার ম্যারাথনে।
পাহাড়ি পথে ধীর ও শান্ত গতির দৌড় আশপাশের চা-বাগানের মানুষসহ পথচারীরা আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন। বিভিন্ন স্থানে পথের পাশের মানুষ দৌড়ে অংশগ্রহণকারীদের হাততালি দিয়ে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানান। ভালো লাগার উচ্ছ্বাসের কথা জানান পলি ইসলাম। তিনি ঢাকা থেকে এসে ১০ কিলোমিটার দৌড়ে অংশ নেন। বলেন- ‘এমনিতে হাঁটি। কিন্তু মাটির রাস্তায় কখনো হাঁটিনি। এই প্রথম ম্যারাথনে অংশ নিলাম। উঁচু–নিচু পাহাড়ি পথ, অসাধারণ।’
শমশেরনগর, কানিহাটি ও বাঘিছড়া চা-বাগানের পথে পথে নানা রঙের টি-শার্ট পরা নারী-পুরুষ ও শিশুর দৌড় সবুজ চাগাছের ফাঁকে ফাঁকে অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়েছে। সিলেট থেকে অংশ নেওয়া আমিনুল হকের ভাষ্য, ট্রেলের আরও চার-পাঁচটা পয়েন্টে স্বেচ্ছাসেবক থাকলে ভালো হতো। অংশগ্রহণকারীরা সবাই নতুন। চিহ্নগুলো নিচু থাকায় অনেকের বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। এ ছাড়া সবকিছু এক্সাইটিং ও প্রাকৃতিক ভিউ অসাধারণ।
দুপুরে কেউ গন্তব্য ছুঁয়ে মাঠের দিকে ফিরছেন, কেউ গন্তব্যের দিকে ছুটছেন। অনেকের কাছে এ রকম পাহাড়ি ও চা-বাগানের পথে দৌড়ানো ছিল একেবারেই নতুন। কেউ ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন প্রথম। নতুন অংশগ্রহণকারীদের উচ্ছ্বাস ছিল অনেক বেশি।
২১ কিলোমিটারে অংশ নেওয়া চট্টগ্রামের শিউলি শবনম বলেন- ‘ট্রেলে এই প্রথম। করোনাকালে অনেক দিন এ রকম ম্যারাথনে অংশ নিইনি। চা-বাগানের মাঝখান দিয়ে দৌড়ানো। দেখা হলো অনেকের সঙ্গে। এটা খুব আনন্দের ব্যাপার।’
সকাল সাড়ে আটটার পর থেকেই গন্তব্য ছুঁয়ে মাঠের দিকে ফিরতে থাকেন রানাররা। ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আয়োজকেরা অংশগ্রহণকারী রানারদের হাতে তুলে দেন ‘ফিনিশার মেডেল’।
এই ম্যারাথন দৌড়ের অন্যতম উদ্যোক্তা শমশেরনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ। তিনি বলেন- ‘এই মাঠে আমরা আরও বড় খেলার টুর্নামেন্ট করেছি। তবে এত বড় ম্যারাথন এই প্রথম। দেশ-বিদেশের অনেকে অংশ নিয়েছেন। এটি ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি এলাকা। এই ম্যারাথনের মাধ্যমে আমরা শমশেরনগরকে দেশ-বিদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’
জানতে চাইলে শমশেরনগর আলট্রা ট্রেল ম্যারাথনের সদস্যসচিব নবিল শমশেরী বলেন- ‘এর আগেও নিজ উদ্যোগে ম্যারাথন করেছি। এবার বড় পরিসরে ম্যারাথন হয়েছে। অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভাবে করা সম্ভব হবে।’
আলট্রা ট্রেল ম্যারাথনে দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, আমেরিকা, নেপাল ও চেক প্রজাতন্ত্র থেকে ৩০ জন অংশ নিয়েছেন।