৫৩৬ দিন ধরে মায়ের সঙ্গে বন্দী শিশুটিও
সময় সংগ্রহ :
মায়ের সঙ্গে বন্দী হয়ে আছে ৯ বছরের লুইসা। সারা দিন শিবিরের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায় সে। এখানে এসে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, তারাও এখন প্রায় কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। অনেকটা একা হয়ে গেছে সে। বাইরে যাওয়ার জন্য সব সময় ছটফট করে সে। স্কুলে যেতে চায়, রান্না করতে চায়। কিন্তু কিছুই হয় না। অথচ মার্কিন নিয়ম অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকে ২০ দিনের বেশি সেখানে আটকে রাখা যায় না।
নিজের দেশের সহিংসতা থেকে বাঁচতে ছোট্ট মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমান আরিয়ানা। কিন্তু ভাগ্য তাঁদের সুপ্রসন্ন হয়নি। এল সালভাদরের এই দুই মা-মেয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বন্দিশিবিরে। ৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সরকারের জিম্মায় মায়ের সঙ্গে ৫৩৬তম দিন কাটাল ৯ বছরের শিশুটি। আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন যেন বিতাড়িত না হন, সেই চেষ্টাই চলছে তাঁদের। মা–মেয়ের এই দীর্ঘ লড়াই নিয়ে বিবিসি তাঁদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। তবে বিতাড়িত হতে পারে, এই আশঙ্কায় মা–মেয়ের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
আইনি সহায়তা সংস্থার তথ্যমতে আইসিইর (ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস অ্যানফোর্সমেন্ট) জিম্মায় সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থাকা অভিবাসী শিশু।
মায়ের বিকল্প কেউ নয় :
যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর প্রায় পুরোটা সময়ই লুইসার কেটেছে টেক্সাসের ডিলিতে সাউথ টেক্সাস ফ্যামিলি রেসিডেনশিয়াল সেন্টারে। সে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মীয়ের কাছে থাকতে পারে। কিন্তু মা–মেয়ে কেউই কাউকে ছেড়ে থাকতে চায় না। ট্রাম্প সরকারের সময় যখন এই মা-মেয়েকে বিতাড়িত করার চেষ্টা চলে তখন তারা একসঙ্গে থেকে আদালতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। লুইসার মা আরিয়ানা বলেন- ‘কেউ কি মায়ের অভাব পূরণ করতে পারে? আমি আমার মেয়েকে ছেড়ে বাঁচব না। আমার মেয়ে খুব ছোট। তার মায়ের মমতা দরকার। আমি কীভাব তাকে ছেড়ে দেব?’
অভিবাসনবিষয়ক আইনজীবীও বলেন- আইসিইর উচিত এই পরিবারকে মুক্তি দেওয়া।
সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন অভিবাসী পরিবারকে আটকের বিরোধিতা করেন। এবং জুনে অভিবাসী শিশু ও তাদের অভিভাবকদের তাৎক্ষণিক মুক্তির দাবি জানান।
কিন্তু এরপরই লুইসার এ ঘটনা দেশটিতে অভিবাসন নীতির জটিলতার বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যা প্রায় ‘অকার্যকর’ বলে অভিহিত করা হয়।
বন্দী অবস্থাতেই কেটে গেল দুটি বড়দিন :
লুইসা বড় ক্লান্ত। তার ভাষ্য- এখানে তার দুটি বড়দিন কেটেছে। খাবার বানাতে পছন্দ করে সে। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নেই। এখানে অল্পবিস্তর ইংরেজি শিখতে পারলেও স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে চায় সে।
আরিয়ানা বলেন- যতই সময় যাচ্ছে মেয়েটার আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। সে শুধু ফল খায়, মাঝে মাঝে না খেয়েই থাকে। ৩১ বছর বয়সী এই মা এখন দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওষুধ খাচ্ছেন।
মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন তিনি। প্রায় দুই বছরে পেরিয়ে গেলেও মেয়ে বেশি কিছু শিখতে পারছে না বলে অস্থির তিনি।
প্রয়েতো ডিলির একজন প্যারালিগাল ম্যাকেঞ্জি লেভি বলেন- তাঁদের অনেক মক্কেলই এই বন্দিশিবিরে শিশুদের শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। শিশুরা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে কিন্তু কখনো কখনো তারা কিছুই শিখে না।
প্রয়েতো ডিলি হলো ইমিগ্রেশন জাস্টিজ ক্যাম্পেইনের স্থানীয় অংশীদার। তাদের কাজ হলো সাউথ টেক্সাস ফ্যামিলি রেসিডেনশিয়াল সেন্টারে থাকা অভিবাসী মা ও সন্তানকে সেবা দেওয়া।
মেলেনি মানবিক আশ্রয় :
আরিয়ানা বলেন- এল সালভাদরে সহিংতার শিকার হয়ে লুইসাকে নিয়ে দেশে ছেড়ে পালান তিনি। পেছনে ছেড়ে আসেন দুই সন্তান। ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত পাড়ি দেন। ২৭ তারিখ তাঁদের নেওয়া হয় ডিলিতে। সেখানে দুই দিন পর এক কর্মকর্তা তাঁদের সাক্ষাৎকার নেন।
প্রয়েতো ডিলির একজন প্যারালিগাল ম্যাকেঞ্জি লেভি বলেন- তাঁদের আশ্রয় চেয়ে করা আবেদনটি দ্রুতই বাতিল হয়ে যায়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করার আগে তারা মেক্সিকো বা গুয়াতেমালায় এ ধরনের আবেদন করেনি। তবে আরিয়ানার আইনজীবী অভিবাসনবিষয়ক আদালতে এর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। সেখানেও আগের আদেশ বহাল থাকে ও তাঁদের বিতাড়িত করার আদেশ দেন। আরিয়ানার আইনজীবী মার্কিন সরকারের কাছে আদালতে হাজির হয়ে আরিয়ানাকে নিজের কথা বলার সুযোগ দিতে আবেদন জানিয়েছেন।
প্রায় বিতাড়িত হয়েই গিয়েছিল :
আরিয়ানা বলেন- অন্তত পাঁচবার তাদের মা-মেয়েকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁদের আইনজীবীর শেষ মুহূর্তে তা ঠেকাতে পেরেছেন। অনেক সময় এল সালভাদরে পাঠানোর উদ্দেশে তাঁদের বিমানবন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দিশিবিরে কেমন কাটছে—জানতে চাইলে লুইসা বলে- ‘আমার খুব রাগ লেগেছিল। তারা একবার আমাদের নিয়ে গেল, আবার ফিরিয়ে আনল আবার পিছু হটল।’
বিভ্রান্তি ও হৃদয়বিদারক :
গত নভেম্বরে অভিবাসীদের অধিকারবিষয়ক ৬০টির বেশি সংস্থা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে ২৮টি শিশুর নাম উল্লেখ করে এক চিঠিতে তাদের মুক্তি দাবি করে। এসব শিশু তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে বন্দিশিবিরে আটক আছে।
নভেম্বরেই আইসিই এক বিবৃতি দিয়ে জানায়- এসব পরিবারের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
সেই ২৮ শিশুর মধ্যে ইতিমধ্যে ছয়জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ১৭ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আর লুইসাসহ পাঁচজন এখনো বন্দী।
লুইসার ১০ম জন্মদিন আসছে। সেই দিনটিতে সে যেন তার আত্মীয়ের বাড়িতে কাটানোর মধ্য দিয়ে মুক্তির স্বাদ খুঁজে পায়, সেই স্বপ্ন দেখছে লুইসা।
সৌজন্যে : প্রথম আলো