সিলেটে তেল সংকটে পেট্রোল পাম্প : রিজার্ভ শেষের দিকে
সময় সংগ্রহ :
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় যানবাহনকে প্রয়োজনমত জ্বালানি তেল দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে পাম্পগুলোকে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে সিলেটের অনেকগুলো পেট্রোল পাম্প। —এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
এম জে এইচ জামিল : সিলেটের পেট্রোল পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। সিলেটের গ্যাসফিল্ড খনিগুলো থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন বন্ধ থাকায় ও ঘন ঘন রেলযোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় এই সংকট তীব্রতর হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় যানবাহনকে প্রয়োজনমত জ্বালানি তেল দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে পাম্পগুলোকে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে সিলেটের অনেক পেট্রোল পাম্প। এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- সিলেটের পেট্রোল পাম্পগুলোকে সিলেটের গ্যাসফিল্ড খনি থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হতো। ফলে চাহিদা পূরণের পরও পাম্পগুলোতে তেলের রিজার্ভ থাকতো। কিন্তু গত ৬ মাস থেকে সেটা বন্ধ করে সিলেটের পাম্প ব্যবসায়ীদেরকে চট্রগ্রাম থেকে ওয়াগনের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় অনিয়ম। প্রয়োজনমত জ্বালানি সরবরাহ না করা, নিম্নমানের জ্বালানি সরবরাহ, জ্বালানি সরবরাহের প্রধান মাধ্যম রেল যোগাযোগ প্রায় সময় বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে সিলেটের পাম্পে থাকা জ্বালানি তেলের রিজার্ভ শেষ হতে চলেছে। ফলে সিলেটে দিনদিন জ্বালানি তেলের সংকট তীব্রতর হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সিলেটের পাম্পগুলো বন্ধ করা ছাড়া মালিকদের কিছুই করার থাকবেনা।
পেট্রোল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে- সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় পেট্রোল পাম্প রয়েছে ১১৪টি। এরমধ্যে সিলেট নগরীতে ৪৫টিসহ জেলায় রয়েছে ৭০টি পাম্প। এসব পাম্পে প্রতিদিন পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেলের চাহিদা ১০ লাখ লিটারেরও বেশি। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয় অর্ধেকের কম। তাছাড়া নিম্নমানের তেল সরবরাহ করার কারণে ক্রেতাদের ক্ষোভের শিকার হন মালিক কর্তৃপক্ষ। মোবাইল কোর্টে অভিযান পরিচালনার কারণে আর্থিক জরিমানা গুণতে হয় পাম্প মালিকদেরকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়- সিলেট বিভাগের ১১৪টি পাম্পে জ্বালানি তেল আসে চট্টগ্রাম থেকে ওয়াগনের মাধ্যমে। কিন্তু ওয়াগন সংকট যেন এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে রিজার্ভ থেকে গ্রাহক চাহিদা পূরণ করতে হয়। এখন রিজার্ভও শেষ হওয়ার পথে। আগে সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করে সিলেটের পাম্পে জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। তখন সিলেটকে কখনও জ্বালানি তেলের সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি। গত ৬ মাস থেকে সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে পাম্পে জ্বালানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে পরিকল্পিতভাবে সিলেটের পাম্প মালিকদেরকে ওয়াগনের মাধ্যমে চট্রগ্রাম থেকে জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে কার স্বার্থে জ্বালানি তেল উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে এমন প্রশ্নও ছুড়েন অনেক পাম্প মালিক। সিলেটের গ্যাস ফিল্ডস খনি থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন ও সিলেটের পাম্পগুলোর মাঝে তা সরবরাহ না করলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয় বলে জানান একাধিক পাম্প মালিক ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়- তেলের মান ভালো নয় জানিয়ে, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে উৎপাদিত পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন ক্রয় বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। সিলেট গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাসের সাথে উত্তোলিত কনডেনসেট বিপিসি ক্রয় না করায় এসব বিক্রি করা হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবার নিজস্ব প্ল্যান্টে পরিশোধন করে জ্বালানি তেল (পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন) বিক্রি করছে বিপিসি’র কাছে। তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্যাস ফিল্ডের কনডেনসেট থেকে পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন উৎপাদন প্লান্ট (ফ্রাকশনেশন প্লান্ট) গুলোতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে আছেন বেকার। বন্ধ হয়ে যায় গোলাপগঞ্জের আরপিজিসিএল ও এলপিজি প্লান্ট। এছাড়া, তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোলাপগঞ্জ কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড থেকে উত্তোলিত অতি উচ্চ মানের এনজিএল (ন্যাচারাল গ্যাস লিকুইড) পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত- তেলের মান উন্নয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য করে গড়ে না তুলে পুরো উৎপাদন কার্যক্রমকে বন্ধ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছেড়ে দেয়ায় পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম উদ্বেগের বিষয়। জ্বালানি তেলের ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান গোলাপগঞ্জের আরপিজিসিএল ও এলপিজি প্লান্ট বেসরকারি পরিচালনায় নিতেই এই অবস্থার সৃষ্টি করা হচ্ছে কি না-এ নিয়েও শংকা জানিয়েছিলেন তারা।
জ্বালানি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- সিলেট গ্যাস ফিল্ড গুলোতে গ্যাসের সাথে উপজাত হিসেবে কনডেনসেট উত্তোলিত হয়। এ থেকে ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের মাধ্যমে পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন উৎপাদন ও উৎপাদিত জ্বালানি বিপিসি’র নিকট বিক্রি করা হতো। বিপিসি’র অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানীর মাধ্যমে জ্বালানী তেল গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে।
জানা গেছে- গ্যাস ফিল্ড গুলো আরওএন ৮৩ (৮৩ অকটেন নম্বর) নম্বরের পেট্রোল উৎপাদন করে। বিএসটিআই বাজারে মান নির্ধারণ করে ৮৯ অকটেন নম্বরের পেট্রোল। এই মান নির্ধারণ করার পরও পূর্বের আরওএন নম্বরের উৎপাদিত পেট্রোল ক্রয় করে বিপিসি। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে রিট হলে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি দেশের সব ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের মতো সিলেট গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদিত তেল মানসম্মত নয় জানিয়ে গ্যাস ফিল্ড এর ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট থেকে তেল ক্রয় বন্ধ করে দেয় বিপিসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- দেশের বিভিন্ন গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ব্যারেল (১৫ লক্ষ ৯০ হাজার লিটার) কনডেনসেট উত্তোলিত হয়। এর মধ্যে শুধু সিলেট বিভাগের গ্যাস ফিল্ড গুলোতে থেকে উত্তোলিত হতো প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ব্যারেল এবং বাকি ৫শ’ ব্যারেল উৎপাদিত হয় দেশের অন্য গ্যাস ক্ষেত্র গুলোতে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে ৭ হাজার ৭শ ৬১ ব্যারেল, সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ড থেকে ১ হাজার ব্যারেল এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন হরিপুর এবং কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড গোলাপগঞ্জ থেকে উৎপাদিত হয় ৭৩০ ব্যারেল কনডেনসেট। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ডে প্রতিদিন ৩শ’ ব্যারেল কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন ক্ষমতার ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট আছে। এছাড়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডে ৩ হাজার ৮শ’ ব্যারেলের ফ্রাকশনেশন প্লান্টসহ প্রতিটি গ্যাস ফিন্ডে ছোট আকারের ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট রয়েছে। অবশিষ্ট কনডেনসেট দেয়া হতো দেশের অন্যান্য স্থানের সরকারি ও বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্লান্টগুলোকে। ৬ মাসেরও অধিক সময় থেকে বিপিসি তেল না নেয়ায় সিলেটসহ দেশের ১২টি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে এবং সব কনডেনসেট দেয়া হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে।
এব্যাপারে বেঙ্গল গ্যাসোলিন পাম্পের স্বত্তাধিকারী ব্যারিষ্টার রিয়াশাদ আজিম হক আদনান এই প্রতিবেদককে বলেন- সিলেটের জ্বালানি তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রধান মাধ্যম রেলপথ। আর খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ আসে সড়কপথে। কিন্তু বর্তমানে সিলেটের রেলপথ ভয়ঙ্কর হয়ে দাড়িঁয়েছে। যেখানে ২/১দিন পর পর ২০/৩০ টা ওয়াগন আসার কথা, সেখানে কখনো কখনো সপ্তাহে আসে ১০ ওয়াগন। আর এই অনিয়মিত সরবরাহের কারণে সিলেটের পাম্পগুলোতে জ্বালানি সংকট তীব্র হচ্ছে। সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে পুনরায় জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু করলে সরকার যেমন রাজস্ব লাভ করবে তেমনি সিলেটের জ্বালানি সংকটও দূর হবে।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগ পেট্রোল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস ডিস্ট্রিবিউটরস এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব জুবায়ের আহমদ চৌধুরী বলেন- সিলেটের পেট্রোল পাম্প ব্যবসা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সিলেটের গ্যাসফিল্ডের পরিবর্তে আমাদেরকে ওয়াগনের মাধ্যমে চট্রগ্রাম থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। যোগাযোগজনিত ত্রুটির কারণে আমাদের রিজার্ভ শেষ হতে চলেছে। অবিলম্বে রিজার্ভ পূর্ণ করে চাহিদামতো জ্বালানি সরবরাহ করা না গেলে মালিকদের পাম্প বন্ধ করা ছাড়া কোন পথ থাকবে না। এক্ষেত্রে সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে সিলেটের পাম্পগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ চালু করার বিকল্প নেই। কি কারণে সিলেটের গ্যাস ফিল্ডের খনি থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ রেখে আমাদেরকে জ্বালানি সংকটের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, এর কোন উত্তর আমরা পাইনি। সিলেটে জ্বালানি সংকটের দ্রুত সমাধানসহ ৬ দফা দাবিতে আমরা গত ডিসেম্বরে পাম্পগুলোতে ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আমরা কর্মসুচী স্থগিত করি এবং মার্চ পর্যন্ত সময় বেধে দেই। কিন্তু আজ অবধি আমাদের কোন দাবী মেনে নেয়া হয়নি। মার্চের ভেতরে আমাদের দাবী মেনে নেয়া না হলে, সিলেটে পেট্রোল পাম্প মালিকগন অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিতে বাধ্য হবেন।
এব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন- ডিসেম্বর মাসে সিলেট বিভাগ পেট্রোল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশনের সাথে এক বৈঠকে তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবী দাওয়া পেশ করা হয়েছে। আমরা তাদের দাবী দাওয়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেছি। তবে পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি তেলে সরবরাহ সংকটের ব্যাপারে তাঁর কিছু জানা নেই বলে জানান তিনি।