রশিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনা : বিসিএস পরীক্ষার জন্য স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন ডা. রুমেল
স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. আমজাদ হোসেন খান। এক ছেলে ও এক মেয়ে তার। দু’জনই চিকিৎসক। ছেলে বউ আর মেয়ে জামাইও চিকিৎসক। একেবারে সোনার সংসার যাকে বলে।
নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দেই সময় কাটছিলো আমজাদ হোসেন দম্পত্তির। এই সোনার সাংসরই আজ আচমকা এক দুর্ঘটনা তছনছ করে দিয়েছে।
আমজাদ হোসেনের ছেলে ডা. ইমরান খান রুমেল। সিলেটের ওইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রভাষক। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর আমজাদ হোসেনও সিলেটের এই বেসরকারি হাসপাতালটিতে কর্মরত আছেন। বিসিএস পরীক্ষা দিতে আজ সকালে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিয়েছিলেন ডা. ইমরান। স্ত্রী অন্তরা খানও চিকিৎসক। তিনি এবারের বিসিএস পরীক্ষার্থী।
চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। বেলা ৩টায় পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। তাই আজ শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরেই স্ত্রীকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন ডা. ইমরান। এনা পরিবহনের একটি বাসে করে সিলেট থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা দেন তারা।
তবে ঢাকা আর যাওয়া হয়নি ডা. ইমরান দম্পতির। সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে আসা মাত্রই দুর্ঘটনার শিকার হয় তাদের বহনকারী বাসটি। বিপরীত দিক থেকে আসা লন্ডন এক্সপ্রেসের একটি বাসকে ধাক্কা দিলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ডা. ইমরান। গুরুতর আহত হন ইমরানের স্ত্রী অন্তরা। এ দুর্ঘটনায় মোট ৮ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় ছেলের মৃত্যুর খবর সকালেই পৌছে যায় ডা. আমজাদ হোসেন খানের কাছে। খবর পেয়েই পড়িমড়ি করে তিনি ছুটে যান ওসমানী হাসপাতালে। যে হাসপাতালে দীর্ঘকাল কাজ করে গেছেন ডা. আমজাদ সেখানেই পড়ে আছে নিজের ছেলের লাশ। নিজেকে কিছুতেই সান্তনা দিতে পারছিলেন না আমজাদ। হাসপাতালের মর্গের সামনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
ছেলেমেয়ে নিয়ে নগরের ফাজিল চিশত এলাকায় থাকেন ডা. আমজাদ। সেখানে গিয়ে দেখা যায় আরও হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় ডা. ইমরানের মা। কোনো কথাই বলতে পারছেন না। কেবল হা-হুতাশ করে চলছেন। পরিবারের সকলেরই একই অবস্থা।
ইমরান-অন্তরা দম্পত্তির দুই মেয়ে। দুজনই শিশু। একজনের বয়স ৫। অপরজনের ২। ঢাকায় যাওয়ার আগে বাবা-মা তাদের নানুর বাড়িতে রেখে গেছেন। এখনও বাসায় ফিরেনি তারা।
ইমরানদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এক নারী বলেন- সকালে ইমরানের বোন ডা. কিন্নরির চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। সে আমাদের ডেকে এই দুর্ঘটনার খবর জানায়। তিনি বলেন- আমজাদের পরিবার খুবই মেধাবী এবং অত্যন্ত ভদ্র। দীর্ঘদিন ধরে আমরা প্রতিবেশি হিসেবে আছি। কিন্তু এই পরিবারের কেউ জোরে কথা বলেছে এমনটি শুনিনি। ইমরানও খুব নম্র ও ভদ্র ছেলে। এরকম মানুষ হয় না।
ইমরানদের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাদের আত্মীয় ডা. মুমিনুল হকের। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দন্ত বিভাগের চিকিৎসক মুমিনুল। তিনি বলেন- সকালে ঘুম থেকে ওঠেই দুর্ঘটনার খবর পেয়েছি। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় যে আমার পরিচতজনেরাও হতাহত হয়েছেন তা বুঝতে পারিনি। পরে ইমরানের কথা শুনলাম।
তিনি বলেন- এতো ভালো একটা পরিবার। তাদের ক্ষেত্রেই এমন দুর্যোগ নেমে এলো। এখন আমজাদ স্যারকে আমরা কি বলে শান্তনা দেবো? ডা. মুমিনুল বলেন- ইমরানের স্ত্রী ডা. অন্তরাও গুরুতর আহত হয়েছেন। এখন আমাদের চাওয়া বাচ্চা দুটোর জন্য হলেও অন্তরা যেনো দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সিলেটগামী লন্ডন এক্সপ্রেস (ঢাকা মেট্রো-ব ১৫-৩১৭৬) ও ঢাকাগামী এনা পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-৭৩১১) মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জন মারা যান। এছাড়া হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও ৪ মারা যান। এই দুর্ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন- সিলেটের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক আল মাহমুদ সাদ ইমরান খান রুমেল (৩৩), এনা পরিবহনের বাসেরচালক ওসমানীনগর উপজেলার ধরখা গ্রামের মঞ্জুর আলী (৩৮), এনার সুপারভাইজার সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মিঠাভরা গ্রামের সালমান খান (২৫), হেলপার ধরখা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন (২৪), বি বাড়িয়ার সরাইল থানার রাজানিয়াকান্দি পশ্চিম পাড়ার নুরুল আমিন (৫০), ঢাকার ওয়ারি এলাকার নাদিম আহমদ সাগর (২৯) ও সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকা শাহ কামাল (২৭) ও ছাতক বাংলাবাজার এলাকার রহিমা খাতুন (২৫)।