বেসামাল সিলেটের চাল ও তেলের বাজার : দিশেহারা মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার :
কোনভাবেই যেন শামাল দেয়া যাচ্ছেনা চাল ও তেলের বাজার। ফলে আরো বেসামাল হতে চলেছে সিলেটের চাল, তেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার। নিয়ন্ত্রণে নেই কোন কার্যকর সরকারী উদ্যোগ। ফলে বাধ্য হয়েই বেশী দামে চাল, তেল-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে হচ্ছে জনসাধারণকে। তবে এই বাজার দরের কারণে হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সহ স্বল্প আয়ের মানুষদেরকে। দৈনিক আয় রোজগারের সাথে বাজার দরের বিস্তর ফারাকে দিশেহারা খেটে খাওয়া মানুষ। তরকারি ও সবজি মূল্য নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকলেও, লাগামহীন চাল, তেল, ডাল, চিনি, রসুন ও আদাসহ কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। বাজার নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে আগামী রমজান মাসে ভয়ানক পরিস্তিতির সম্মূখীন হতে হবে বলে মনে করেন জনসাধারণ।
জানা যায়- কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে দেশে দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে শুরু করে। আর ধানের বাম্পার ফলনের পরও সিন্ডিকেটের কারণে উর্ধ্বমূখী চালের বাজার। এদিকে গত ১৭ ফেব্রুয়ারী বুধবার সচিবালয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি “অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের মূল্যের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেন। প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলে গেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সভায় প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১২৭ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১৩৫ টাকা। পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৮৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৬০০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ৬২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দেশে ব্যবহৃত তেলের ৭০ শতাংশ পাম সুপার, যার প্রতি লিটার মিলগেট মূল্য (খোলা) ৯৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৯৮ টাকা এবং খুচরা বাজারে ১০৪ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।” ঐ বৈঠকে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে এ দাম ঠিক করা হয়েছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন- “সামনে রমজান মাস, বর্তমানে যথেষ্ট মজুদ আছে। সব হিসেব-নিকেশ করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ঘোষণার পর শক্ত হাতে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে। দাম কমে গেলে বিবেচনা করা হবে, বেড়ে গেলেও বিবেচনা করা হবে। আমরা যে তেল ব্যবহার করি তার ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। তাই একটু মূল্য দিয়েই তেল কিনতে হবে।
নগরীর বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করে জানা যায়- সরকার ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও আমাদের কিছুই করার থাকেনা। কারণ আমরা বেশী দামে ক্রয় করে তো আর লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে পারবো না। এদিকে টিসিবি থেকে শুধু তেল কেনার সুযোগ না থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেকে টিসিবি থেকে বাজার করতে পারছেন না। টিসিবি থেকে পেঁয়াজ, তেল, আলু, চিনি, ডাল সহ প্যাকেজ বিক্রি করা হয়। তাই কাউকে কিনতে হলে প্যাকেজ কিনতে হয়। বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজের মূল্যকম থাকায় অনেকে টিসিবি থেকে বাজার করা থেকে বিরত রয়েছেন। গতকাল সিলেটের বাজারে ভোজ্য তেল সয়াবিন (ভালো মানের) বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা ধরে। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে বাজার সূত্রে জানা যায়। শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল নয়, খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও চড়া। চারজনের একটি পরিবারে মাসে পাঁচ লিটারের মতো তেল লাগে। ফলে একটি পরিবারে ছয় মাস আগের তুলনায় এখন মাসে তেলবাবদ খরচ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা বেশি। গত সপ্তাহে ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, মসুর ডাল ও অ্যাংকর ডালের দাম কিছুটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এর মতে- ‘দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, করোনায় আয় কমে যাওয়া মানুষ খাওয়ার অন্যান্য খরচ কমিয়ে শুধু কয়েকটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাজার ব্যয় সীমিত করে এনেছে। চাল ও ভোজ্যতেল তাদের খাদ্যতালিকার সবচেয়ে জরুরি পণ্যের মধ্যে থাকে। দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়- চাল, ডাল, চিনি ও ভোজ্য তেলের বাজারে অস্বস্তি কাটেনি। এর মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। এ সপ্তাহে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। সিলেটের সবজি বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। বাজারে সবজির সরবরাহও বেশী থাকায় সবজি নিয়ে চিন্তামুক্ত জনসাধারণ।
গতকাল শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়- আগের সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল কেজিতে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা চলছে। একই অবস্থা রসুনেরও। আগের সপ্তাহে দেশি রসুন ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গতকাল ১২০ টাকা পর্যন্ত দাম চাইলেন বিক্রেতারা। আমদানি করা রসুনের দাম ১০ টাকা বেড়ে ১১৫ থেকে ১৩০ টাকায় উঠেছে। দেশি আদা কেনা যেত ৭০ থেকে ১১০ টাকা কেজিতে, এখন ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজি, আমদানি করা আদা কিনতে হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়।
এদিকে সরকারী নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়- ভোজ্য তেলে সুখবর আসতে পারে আগামী মার্চে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে সামনে সয়াবিনের মৌসুম শুরু হচ্ছে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে আসবে। এ সময় মালয়েশিয়ার পাম অয়েলের পিক সিজনও শুরু হবে। বাজারে তদারকি থাকলে দাম কমতে পারে বলে মনে করেন নগরীর বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতা। তবে তেলের বাজারে স্বস্তি পেতে আরো এক থেকে দুই মাস অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই।
গতকালও খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা লিটার দরে। পাম সুপার অয়েল বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকা এবং পাম লুজ অয়েল বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা লিটার দরে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় উঠেছে। একসঙ্গে পাঁচ লিটার নিলে ৬৫০ থেকে ৬৯০ টাকা পর্যন্ত রাখছেন বিক্রেতারা। বড় দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা কমে ৭৫ থেকে ৭০ টাকায় নেমেছে। ছোট দানার দেশি মসুর ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি। ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে চিনির উপর থেকে শুল্কহার কমানো হলে বাজারে এর প্রভাব বাজারে দেখা যায়নি। চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে, যা মাসখানেক আগেও ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ছিল। টিসিবির হিসাবে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৫ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে চিনির দাম। রমজান মাস সামনে রেখে আরো বাড়তে পাড়ে এমন শঙ্কায় ছিলেন ক্রেতারা। তাই চিনির দামে লাগাম টানতে আমদানিকারকদের ৪ শতাংশ আগাম কর অব্যাহতি দেয় সরকার। গত ৩১ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এর স্বাক্ষর করা বিশেষ আদেশ জারি করা হয়েছে। আদেশ অনুযায়ী, নিবন্ধিত রিফাইনাররা এই সুযোগ নিতে পারবেন।
নগরীর বিভিন্ন সবজি বাজার ঘুরে দেখা যায়- বাজারে সব ধরনের সবজির সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। শিম, টমেটো, বেগুন, গাজরসহ প্রায় সব ধরনের সবজি নগরীতে বিক্রি হচ্ছে মোটামুটি কম দামে। কারণ সবজি বাজার নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার কোন অভিযোগ নেই। গতকাল শুক্রবার নগরীর আম্বরখানা ও বন্দরবাজারের খুচরা বাজারে টমেটো প্রতি কেজি ১০-১৫ টাকা, শালগম ১০-১৫ টাকা, ফুলকপি ২০ টাকা, বাঁধাকপি ১৫ থেকে ২০ টাকা, তাল বেগুন ২৫ টাকা, বেগুন ১৫ থেকে ২০ টাকা, গাজর ২৫-৩০ টাকা, খিরা ২৫ থেকে ৩০ টাকা, শসা ৩০-৩৫ টাকা, শিম প্রকার ভেদে ২০ থেকে ৩৫ টাকা, শিমের বিচি ৬০ থেকে ৮০ টাকা, মুলা ২০-২৫ টাকা, কাচা মরিচ ৬০-৭০ টাকা, ধনিয়া পাতা ৬০-৮০ টাকা, আলু প্রকার ভেদে কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়।
এদিকে নগরীর চালের বাজার ঘুরে দেখা গেছে- নতুন মোটা চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) প্রকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২১০০ থেকে ২১৫০ টাকা। নতুন স্বর্ণা ২৩০০ থেকে ২৩৫০ টাকা, রনজিত চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) জাতভেদে ২৩০০ থেকে ২৩৫০ টাকা, আশুগঞ্জের ৪৯ সিদ্ধ চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) প্রকারভেদে ২৪৫০ থেকে ২৫৫০ টাকা। স্থানীয় হিরা পুরাতন চাল ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকা, ‘২৯’ মালা চাল ২৬০০ থেকে ২৬৮০ টাকা, ‘২৮’ চাল ২৭০০ থেকে ২৭৫০ টাকা, আশুগঞ্জের পুরাতন ‘২৮’ চাল ২৮৫০ থেকে ২৯০০ টাকা, আশুগঞ্জের পুরাতন ‘২৯’ চাল ২৬৫০ থেকে ২৭৫০ টাকা, নতুন মুক্তা শাইল মোটা চাল ২১৫০ থেকে ২২০০ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট নতুন (৫০ কেজি বস্তা) ৩৫৫০ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট পুরাতন ২৭০০ টাকা, জিরা সিদ্ধ মানভেদে ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকা, নাজিরশাইল সিদ্ধ ভারতীয় (২৫ কেজি বস্তা) ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকা, নাজিরশাইল সিদ্ধ দেশী ২৮৫০ থেকে ২৯০০ টাকা, পাজাম সিদ্ধ ভারতীয় ২২৫০ টাকা, পাজাম সিদ্ধ দেশী ২৩৫০ থেকে ২৪০০ টাকা, কাটারি ভোগ ৩১০০ থেকে ৩৩০০ টাকা, চিনিগুড়া চাপাইয়ের ৪৩০০ থেকে ৪৪০০ টাকা, চিনিগুড়া দিনাজপুরী ৩৮০০ থেকে ৪০০০ টাকা, চিনিগুড়া জামালপুর ৩৫০০ থেকে ৩৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর বিভিন্ন খুচরা দোকানে প্রতি কেজি জিরা সিদ্ধ ৬৫-৬৮ টাকা, স্থানীয় মালা ৫৩-৫৬ টাকা, মালা ৬০-৬২ টাকা, কাটারি সিদ্ধ ৬২-৬৫ টাকা, মিনিকেট সিদ্ধ ৫৭-৬০ টাকা, কাটারি ৭০-৭২ টাকা ও চিনিগুড়া ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর কাজলশাহ এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দিলোয়ার হোসেন বলেন- অন্যান্য বাজার যেমন তেমন চাল আর তেলের বাজার নিয়ে আমরা আছি মহাসংকটে। সংসার জীবনে এই দুইটি জিনিসের ব্যবহার বেশী থাকায় বাধ্য হয়েই বেশী দামে চাল ও ভোজ্য তেল কিনতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে নগরীর কালিঘাট চাল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমদ দৈনিক গণমাধ্যমকে বলেন- দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বতর্মানে চালের বাজারে বিক্রি কমে গেছে। এজন্য ব্যবসায়ীগণ নতুন করে চাল কিনতে বহু হিসেব নিকেশ করছেন। তবে আগামী সপ্তাহে সরকারীভাবে চাল আমদানী হলে চালের দাম কমতে পারে।