দেশব্যাপী কারফিউ চান বিশেষজ্ঞরা
সময় সিলেট ডট কম
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে দেশে আরোপ করা ‘বিধিনিষেধ’ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও কোভিডে মৃত্যু ও শনাক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকার মধ্যেই সিটি করপোরেশন এলাকায় খুলে দেওয়া হয়েছে গণপরিবহন। আজ শুক্রবার থেকে খুলে দেওয়া হচ্ছে শপিং মল ও বিপণিবিতান। সরকারের পরামর্শক কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে সবখানে। এ নিয়েও উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই এবং এটি কার্যকর করতে সরকার প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে পারে এবং জারি করতে পারে কারফিউ।
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের গতি থামাতে গত ২৯ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। পরে ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা জনসাধারণের মাঝে লকডাউন নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু সেটি ভেঙে পড়েছে দুদিনেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিও নিশ্চিত করা যায়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, মহাখালী ও তেজগাঁও এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। বেশির ভাগ মানুষকে মাস্ক ছাড়াই নির্বিঘ্নে বাসে ওঠানামা করতে দেখা যায় ঠেলাঠেলি করে। অন্যদিকে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর তৎপরতাও দেখা যায়নি রাজধানীর কোথাও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বাস্তবসম্মত লকডাউন ছাড়া সংক্রমণের গতিরোধ করার আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সশস্ত্র বাহিনী যাদের দিয়ে অন্য দেশে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, আমাদের দেশেও তা করতে হবে। ন্যূনতম দুই সপ্তাহ কঠোর লকডাউন দিয়ে সব বন্ধ রাখতে হবে। যেকোনো ধরনের জমায়েত বন্ধ করতে কঠোরতার পাশাপাশি লকডাউনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাদের সরাসরি সহায়তা নিশ্চিত করে আগ্রহী করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এবারের বিধিনিষেধ কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে ব্যবসায়ীদের চাপ আর মানুষের দুর্ভোগ কমাতে যান চলাচলে অনুমতি দেওয়ার কারণেই। আবার জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অভিভাবকের জমায়েতের সুযোগ দেওয়া কিংবা মেলা চালু রাখা ছাড়াও নানা জায়গায় সমাবেশ করতে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।’ তিনি বলেন, ‘ঘোষণা করা হয়েছে কাল (শুক্রবার) থেকে শপিং মল ও বিপণিবিতান খোলা থাকবে। সরকারের এই দ্বিমুখী আচরণের চরম মূল্য দিতে হবে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে বড় ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হবে এটা নিশ্চিত।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক উত্তম বড়ুয়া বলেন, ‘সরকার এক সপ্তাহের একটি বিধিনিষেধ (জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ) ঘোষণার দুদিনের মধ্যে তা শিথিল করেছে কয়েকটি গ্রুপের দাবির মুখে, এটা ঠিক হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এটা শিথিল করার পেছনে কারণ হলো জনগণের একটি অংশ বিধিনিষেধ তাদের মতো করে মানতে চায়। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সুবিধাভোগী গ্রুপের স্বার্থ জলাঞ্জলি যেতেই পারে। কিন্তু বড় পরিসরে সরকারকে কঠোরভাবে মানানোর ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বায়োটেকনিক্যাল ও এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহিদুস সামাদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশে কোভিড সংক্রমণের হার ভীষণভাবে বেড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিদিন কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা নতুন রেকর্ড ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখনো ভাবিনি এক বছর পরে এসে আমরা আগের চেয়ে ভীতিকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকব। এখন মনে হচ্ছে যে, শতাব্দীর ভয়াবহ এই মহামারির সঙ্গে আসলেই আগামী বছরগুলোতে আমাদের সহাবস্থান করতে হবে। এর সংক্রমণের ট্রেন্ড যে আরো কত রূপ দেখাবে, কে জানে!’ এই তরুণ গবেষক আরো বলেন, ‘এপ্রিলের মাঝে যদি দৈনিক শনাক্ত সংখ্যা ১০ হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা একশর কাছাকাছি পৌঁছে, তাহলেও হয়তো তা অপ্রত্যাশিত হবে না।’ তিনি সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সবকিছু খুলে দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রাত্রিকালিন কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানায় সরকারের উচিত হবে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করা।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, লোকাল প্রশাসন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, এনজিওকর্মী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সর্বত্র মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সরকারের উচিত গরিব মানুষের জন্য বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করা।’
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গণপরিবহনের পর শপিং মল খুলে দেওয়ায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এগুলো সরকার পরীক্ষামূলকভাবে করছে। সরকার এবং যারা এগুলো খোলায় চাপ প্রয়োগ করেছিল তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানায় তৎপর হতে হবে। তবে করোনায় মৃত্যুর যে হার তাতে সরকার চাইলে এসব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে।’