এমপিও নীতিমালা কতটা শিক্ষাবান্ধব
মাছুম বিল্লাহ
২৯ মার্চ (২০২১) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও জনবল কাঠামোর নীতিমালা প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন এমপিও নীতিমালার লুক্কায়িত গুরুত্ব হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষার যে বিশাল অংশ বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেটি বেসরকারিই থেকে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষক এবং শিক্ষক সংগঠন বিভিন্নভাবে এটিকে উপস্থাপন করেছিল যে, শিক্ষা জাতীয়করণ হচ্ছে। নতুনভাবে এমপিও নীতিমালা তৈরি করার অর্থ হচ্ছে শিক্ষা জাতীয়করণ হচ্ছে না। এর কারণ শুধুই অর্থনৈতিক নয়। বর্তমান সরকার দ্বিতীয়বারে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছিল; সেগুলোর শিক্ষকদের মান নিয়ে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেটি একটি কারণ। মাধ্যমিকে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে আসছিল তাতে এ ধরনের শঙ্কা অমূলক নয়। তবে এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ শুরু হওয়ায় কিছুটা আশান্বিত হওয়ার জায়গা তৈরি হয়েছে, যদিও একেবারে স্মার্ট কিছু ঘটেনি। আর একটি কারণ হতে পারে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা না থাকলে শিক্ষার মান নিয়ে হয়তো কেউ ভাববেন না। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই প্রতিযোগিতার কারণে। সব একই মানের ও একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে মানের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাবে। তবে জাতীয়করণ করলে মান নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করা যেত। আমরা আর একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, কলেজ এমপিওভুক্তীকরণ বিষয়টি আগের চেয়ে জটিল করা হয়েছে অর্থাৎ কলেজ শিক্ষাকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাকে বাস্তবসম্মত কারণেই সরকার বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু কলেজে পড়ে বেকার সৃষ্টি করা বিষয়টিতে সরকারি একটু নড়েচড়ে বসেছে। সম্ভবত এ কারণেই কলেজের এমপিওভুক্তীকরণ বিষয়টিকে কিছুটা জটিল করা হয়েছে।
কিছু কিছু মহল এমপিওকরণ বিষয়টিকে বেশ রংটং লাগিয়েছে যদিও মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে যে, এখনই নতুন স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে না। এ খাতে বরাদ্দ না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নীতিমালার সুফল ভোগ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের অক্টোবরে সরকার আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। তখন ঘোষণা ছিল, নীতিমালা হালনাগাদ করে ফের এমপিওভুক্তির আবেদন নেওয়া হবে। এ কারণে নীতিমালা সংশোধনের ঘোষণায় এমপিও না পাওয়া প্রায় সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা আশায় বুক বেঁধেছেন। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের আর মাত্র তিন মাস অবশিষ্ট আছে। এ সময়ে আবেদন নিয়ে দাপ্তরিক কাজ শেষ করে এমপিও দেওয়া সম্ভব হবে না। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির খাতে বর্তমানে কোনো বরাদ্দ নেই।’ তবে এ খাতে কখনোই আগে থেকে বরাদ্দ থাকে না। রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলে পরে বিশেষ বরাদ্দ হয়ে থাকে। এসব কারণে এ অর্থবছরে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সম্ভাবনা কম। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলে আগামী অর্থবছরে এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।
মোট ৪৪ পাতার নীতিমালায় সহকারী শিক্ষকদের সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়েছে। এর আগে সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ ছিল না। সরকারি স্কুলের সঙ্গে কিছুটা মিল রেখে সেটি করা হয়েছে, এটি ভালো দিক। সহকারী শিক্ষকরা যোগদানের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করলে ১০ম গ্রেডে বেতন পাবেন। ১০ম গ্রেড প্রাপ্তির ১০ বছর পূর্তিতে তারা সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাবেন। ১০ম গ্রেড পাওয়ার ১০ বছর পূর্তিতে সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকরা ৯ম গ্রেডে বেতন পাবেন। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজে কর্মরত গ্রন্থাগারিক, সহকারী গ্রন্থাগারিক ও ক্যাটালগারদের শিক্ষকের মর্যদা দেওয়া হয়েছে। এটিও ভালো দিক।
ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষক বা অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) প্রভাষকরা হবেন সিনিয়র প্রভাষক। তাদের বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক বলা হয়। এটা এখন থেকে শুধু কলেজ শিক্ষকদের বলা হবে। তবে সিনিয়র প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকদের বেতন স্কেল একই থাকবে। এখানে প্রয়োজন ছিল শিক্ষকদের পদগুলো সিনিয়র শিক্ষকের পরে প্রভাষক, সিনিয়র প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সিনিয়র সহযোগী অধ্যাপক, পরে অধ্যাপক ও সিনিয়র অধ্যাপক। প্রশাসনিক চাকরি ছাড়াও অন্যান্য অনেক চাকরির সঙ্গে শিক্ষকতা পেশাটা মেলানো ঠিক নয়, কিন্তু সমাজে তুলনাটা সবাই করে থাকেন অন্যান্য পেশার সঙ্গে। তাই শিক্ষকদের ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলো থাকা উচিত এমন করে এবং প্রতিটি পদের বেতন স্কেল ও সুযোগ-সুবিধা আলাদা থাকা উচিত। তাহলে চাকরির একটি আকর্ষণ থাকবে। একবার প্রভাষক হওয়ার পর যদি আট-দশ বছর চাকরি করতে হয় এবং তারপর সহকারী অধ্যাপক হতে হয়, তাতে চাকরির আকর্ষণ থাকে না। আর সিনিয়র প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকের বেতন সমান থাকবে এ কেমন কথা? এটি ঠিক নয়।
এত দিন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি পেতে নিম্ন মাধ্যমিকে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ জন শিক্ষার্থী, মাধ্যমিকে শহরে ৩০০ ও মফস্বলে ২০০, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহরে ৪৫০ ও মফস্বলে ৩২০, উচ্চমাধ্যমিক কলেজে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ এবং ডিগ্রি (স্নাতক পাস) কলেজে শহরে ২৫০ ও মফস্বলে ২০০ শিক্ষার্থী থাকার শর্ত ছিল। ২০২১ সালের নীতিমালা অনুযায়ী নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি পেতে নিম্নমাধ্যমিকে শহরে ১২০ ও মফস্বলে ৯০, মাধ্যমিকে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহরে ৪২০ ও মফস্বলে ৩২০, উচ্চমাধ্যমিক কলেজে শহরে ২৫০ ও মফস্বলে ২২০ এবং ডিগ্রি কলেজে স্নাতকে শহরে ৪৯০ ও মফস্বলে ৪২৫ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। পাসের হারের ক্ষেত্রে জেএসসিতে শহরে, জেলা সদরে/পৌরসভা ও মফস্বল এই তিন ক্যাটাগরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাসের ন্যূনতম হার হতে হবে যথাক্রমে ৭০, ৬৫ ও ৬০ শতাংশ। এসএসসিতে ৭০, ৬০ ও ৫৫ শতাংশ। এইচএসসিতে শহরে ৬৫, জেলা সদর ও পৌরসভায় ৫৫ এবং মফস্বলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ।
বিদ্যালয়ে নিয়োগের ৫ বছরের মধ্যে শিক্ষায় অর্থাৎ বিএড ডিগ্রি নিতে হবে। যাদের এখন এ ডিগ্রি নেই তাদেরও ৫ বছরের মধ্যে নিতে হবে। আর ডিগ্রি কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেওয়া যাবে না। শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ থেকে নেওযা যাবে। কেন? দেশে এখন ভালো মানের বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোকে বিএড ডিগ্রি দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া উচিত। এগুলোর ডিগ্রি কোনো সরকারি কলেজ বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির চেয়ে ভালো বৈ মন্দ হবে না। তবে যেনতেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকা ভালো। কোনো কারণে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও শিক্ষকদের চাকরি যাবে না। এটি একটি ধনাত্মক সিদ্ধান্ত। তাদের পাশের বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শূন্যপদে নিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা-সাপেক্ষে বেসরকারি শিক্ষকরা বদলি হতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে শূন্যপদ ও দুই প্রতিষ্ঠানের সম্মতি লাগবে। এটিও ভালো দিক যদিও কেউ কেউ বলছেন এতে অপেক্ষাকৃত ভালো প্রতিষ্ঠানে বদলির জন্য অনেকে তদবির করবেন। সেটি মিনিমাইজের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
নীতিমালায় আরো কিছু ইতিবাচক দিক যুক্ত হয়েছে। এনটিআরসির মাধ্যমে সব ধরনের শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষক চাহিদা জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে আসতে হবে। আর ভুল চাহিদার জন্য এ তিনস্তর দায়ী থাকবে। এমপিওভুক্তি করা হবে বিশেষায়িত কমিটির মাধ্যমে। এগুলো ভালো সিদ্ধান্ত। তবে শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের দাবি ছিল আলাদা বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন করে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। সেই বিষয়টিও বোঝা যাচ্ছে অনেকটাই চাপা পড়ছে। স্কুলে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিজের বিষয়ের বাইরে আরো দুটি বিষয়ে ক্লাস নেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। স্কুল-কলেজে আলাদা শিফটের শিক্ষকদের এমপিও দেওয়া হবে। তবে তাদের আলাদা ছাত্রছাত্রী, পাসের হার থাকতে হবে। অন্য শিফটের শিক্ষার্থী ও পাসের হার দেখানো যাবে না। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রাঞ্চ খুলতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। বর্তমানে প্রাপ্যতার বাইরে যারা নিযুক্ত আছে, তাদের চাকরি থাকবে। কিন্তু জনবল কাঠামোর মধ্যে কোনো পদ শূন্য হলে তাতে অতিরিক্তরা নিয়োগ পাবেন। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো করছে এবং সমাজে তাদের চাহিদাও আছে। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের ব্রাঞ্চ খুলতে পারবে না কেন? যারা ভালো করছে, তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত। মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে, কথাটি যত সহজে বলা যায় কাজ তো তত সহজে হয় না। এখানে তো বিশাল আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফেলে দেওয়া এবং অনৈতিক লেনদেনের সুযোগের গন্ধও থেকে যায়।
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
masumbillah65@gmail.com