উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হওয়া রাজনীতির জন্য কতটুকু শোভনীয়?
শেখ জাফর আহমদ
গ্রামবাংলার একটি প্রবাদ আছে- আম গাছের নিচে আম হয়, জাম গাছের নিচে জাম হয়। আম গাছের নিচে যেমন জাম হয় না তেমনি জাম গাছের নিচেও আম থাকার কথা না। কিন্তু প্রশ্ন হলো- একটি পরিপক্ষ আম গাছের নিচে যে গাছটি গড়ে উঠল, সেই গাছটি পরিপক্ষ কিনা? সেই গাছের ডালপালা, ফলমুল পরিপক্ষ গাছের ন্যায় মান সম্পন্ন কিনা?
বর্তমান সমাজে আমাদের দেশে মোটামুটি একটা প্রচলন শুরু হয়ে গেছে, রাজনৈতিক দলের অনেক নেতার সন্তানাদি, ভাই-বোন কিংবা স্ত্রী উত্তরাধিকার সূত্রেই এমপি হয়ে যাচ্ছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব অনায়াসেই গ্রহন করছেন। অথচ তাদের রাজনৈতিক কোন ইতিহাস নেই, ছাত্র রাজনীতি, যুব রাজনীতি এবং পরিপূর্ণ রাজনীতি কোনটারই কোন অভিজ্ঞিতা তার মাঝে বিদ্যমান নেই।
বড় নেতার সন্তান, ভাই-বোন কিংবা স্ত্রী হবার সুবাধে তার বাল্যকাল কেটেছে হয় বিদেশে নতুবা চার দেয়ালের গন্ডীর ভিতরে দেশের কোন এক নামিদামী প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্টানে।
লেখাপড়া শেষ করে উচ্চতর কোন ডিগ্রী লাভ করে সোজা নেমে পড়েন রাজনীতির স্বর্ণশিখরে। হয় দলের উচ্চতর কোন পদ কিংবা স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নমিনেশন দখলে। নিরুপায় দলের নেতা-কর্মীরা বাহ! বাহ! আর করতালির মাধ্যমেই তাদেরকে বরণ করে নিতে হয়। কারন দলের নির্দেশ। দলীয় নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য কারো নাই। যারা অমান্য করেছেন তাদের রাজনীতির ইতিহাস হয় নির্বাসনে গিয়েছে নতুবা চিরতরে কবর দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে মান-অভিমানে রাজনীতি থেকে সরে দাড়িয়েছেন -এটাই চরম এবং নির্মম বাস্তবতা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃণমূল বলে একটি শব্দ খুবই পরিচিত। সব দল থেকেই বলা হয়- যেহেতু তৃণমূলই সংগঠনের প্রান, সেহেতু তৃণমূলকেই প্রধান্য দেওয়া হবে। তৃণমূলের জরীপের ভিত্তিতে দলের নেতা বা কান্ডারী নির্বাচিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আদৌ কি তা হচ্ছে?
নির্বাচিত কোন এমপি মৃত্যু বরণ করলে কিংবা কোন কারনে সেই আসন শূন্য হলে প্রথমেই আওয়াজ তোলা হয় সদ্যপ্রয়াত এই এমপির পারিবারের কাউকে না কাউকেই নমিনেশন দিতে হবে। কারন তার অসামপ্ত কাজ এবং স্বপ্ন পূরনে পরিবারের সদস্যের কোন বিকল্প নেই। (তবে যদি পারিবারিক ভাবে কেউ সেই দলের পরিক্ষীত সৈনিক এবং যোগ্য থেকে থাকেন, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা) এমনকি পরিবারের সদস্যরাও জোর দাবী করে বসেন তাদের পাওনা তাদেরকেই বুঝিয়ে দিতে হবে।
কি আজব ঘটনা? মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি কোন না কোন দলের সদস্য ছিলেন, কোন না কোন দল থেকে নমিনেশন পেয়ে, দলের সর্বাত্মক সহযোগিতায়, জনগনের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। মৃত্যুবরন করার পর তিনি পারিবারিক সম্পত্তি হয়ে যান কিভাবে? একক পরিবারের সহযোগিতায় কিংবা একক ভূমিকায় তিনি তো নির্বাচিত হননি। মৃত্যুর আগ মুহুর্ত যিনি দলের সম্পদ এবং জনগনের প্রতিনিধি ছিলেন, অথচ মৃত্যুর পরে সেই তিনি পারিবারকেন্দ্রীক প্রতিনিধি বনে যান কোন যুক্তিতে?
প্রত্যেক মানুষেরই জীবনের স্বতন্ত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। একজন মানুষ তার জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে, রাজনীতির বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে, রাজনীতির মাঠে অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে তার রাজনৈতিক জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে, গাছের পাকা ফল যদি অন্য কেউ চিনিয়ে নেয়, অথবা অন্য কাউকে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোগ করতে দেওয়া হয়, সেটা নিঃসন্দেহে সুখকর নয়। বরং খুবই দুঃখজনক, পীড়াদায়ক এবং বেদনাদায়ক!
এহেন সিদ্ধান্ত রাজনীতির জন্য মোটেও শুভনীয় নয়। এতে করে রাজনীতিবিদরা যেমন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন, তেমনি কর্মী-সমর্থকরাও হতাশায় ভোগেন। নিজেদেরর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।
যা যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষতিকর।
সুতারাং দলের কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে, দলের নেতা-কর্মীর সাংগঠনিক কাজের ধারা অব্যাহত রাখতে, নিজ দলের প্রতি আত্নবিশ্বাসী হয়ে দলের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা’সহ যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মনোবল বাড়াতে মাঠ পর্যায়ের তথা তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে যে কোন সময়, যে কোন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া উচিত বলে মনে করি।
আমরা যারা সাধারণ জনগণ এবং দলের কর্মী-সমর্থক রয়েছি, আমাদের বোঝা উচিত বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০ বছর, আর কতো বছর হলে পরে পরিবারকেন্দ্রীক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার মনমানসিকতা সৃষ্টি হবে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী, রাজনৈতিক কর্মী।
[বি.দ্র. : মুক্তকথন বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে ‘দৈনিক সময় সিলেট’ এর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। ‘দৈনিক সময় সিলেট’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তকথনে প্রকাশিত লেখার দায় ‘দৈনিক সময় সিলেট’ নয়।]