ঈদের আনন্দ নেই তাঁদের মনে
সময় সংগ্রহ :
মানাউবী সিংহ, (সিলেট) : সর্বশেষ চার দিন আগে কাজ পেয়েছিলেন দিনমজুর মো. সাগর মিয়া। সেদিন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে মাটি কাটার কাজ করে মজুরি পেয়েছিলেন ৫০০ টাকা। তবে বুধবার (১২ মে) সকাল আটটা পর্যন্ত কোনো কাজ জোটেনি কপালে। বাড়ি কুমিল্লার চাঁদপুরের মতলবে হলেও তিনি দুই শিশুসন্তান, স্ত্রীসহ থাকেন সিলেটের কালীঘাট ছড়ার পাড় এলাকায়।
স্ত্রী–সন্তানকে ঈদের নতুন-কাপড় তো দূরের কথা, সেমাই খাওয়াতে পারবেন কি না, এ নিয়ে চিন্তায় আছেন সাগর মিয়া। ঈদে বাড়ি যাওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন- ‘কাজ নাই, টাকা পামু কই। এত দূর তো হেঁটে যাওয়া যায় না। এখন পরিবার নিয়ে ঈদ কাটানোই বড় দায়।’
আরেক দিনমজুর শওকত হোসেন। নরসিংদীর রায়পুরে বাড়ি তাঁর। স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা সেখানেই থাকেন। সামনে ঈদ, কিন্তু বাড়ি যাওয়ার ভাড়া নেই তাঁর। সর্বশেষ কাজ পেয়েছিলেন পাঁচ দিন আগে। ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য শিশুসন্তান ও স্ত্রী বারবার ফোন দিচ্ছেন। কিন্তু দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলছে না। এখন বাড়ি গেলে আগের তুলনায় অন্তত আড়াই গুণ বেশি ভাড়া লাগবে। এসব চিন্তা করে পা আর চলে না।
বুধবার সকাল সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত সিলেটে শ্রমের হাট নামে পরিচিত বন্দরবাজার, শাহজালাল উপশহর এবিসি মোড়, ওসমানী মেডিকেল কলেজ এলাকা ও মদিনা মার্কেট এলাকায় কাজের অপেক্ষায় থাকা দিনমজুরেরা জানাচ্ছিলেন করোনায় দুরবস্থার কথা। তাঁরা বলেন- প্রায় এক বছর ধরে করোনায় কাজ পাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কাজ না থাকায় ঈদ এলেও তাঁদের কারও মুখেই নেই হাসি কিংবা মনে কোনো আনন্দ। ঈদের দিনও তাঁদের কাছে সাধারণ দিনের মতোই। সেদিনও কাজের সন্ধানে ঘর থেকে বাইরে বের হতে হবে তাঁদের।
বুধবার সকাল সাতটার দিকে সিলেট নগরের চারটি শ্রমের হাট সরেজমিন দেখা গেছে- প্রতিটি হাটেই ২৫-৩০ জনের একটি দল সড়কের পাশে সারি ধরে বসে আছে। এর মধ্যে তরুণ থেকে বৃদ্ধ নারী ও পুরুষ সদস্যরা রয়েছেন। অনেকের সঙ্গে কোদাল ও ঝুড়ি। অগন্তুক কাউকে দেখলেই কয়েকজন মিলে একসঙ্গে জড়ো হচ্ছেন। জিজ্ঞেস করছেন কাজের জন্য মানুষ লাগবে কি না।
শ্রমজীবীরা জানান- করোনায় কাজ নেই। অনেকে টাকার জন্য কাজ বন্ধ রেখেছেন। সবারই একই অবস্থা। অনেকে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে কাজের সন্ধানে হাটে আসেন। কিন্তু দিনভর অপেক্ষা করেও কাজ না পেয়ে আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার করোনার কারণে পেশা বদল করে দিনমজুরি করতে এসেছেন। সাধারণত সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাঁরা। দৈনিক একেকজন মজুরি হিসেবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পান। এর মধ্যে নারীদের মজুরি কিছুটা কম। সাধারণত মাটি কাটা, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ করে থাকেন তাঁরা। আবার কেউ কেউ সারা দিন কাজ না করিয়েও কয়েক ঘণ্টা কিংবা চুক্তিতে কাজ করান। সে ক্ষেত্রে মজুরি কিছুটা কমবেশি হয়।
শ্রমজীবীরা বলছেন- করোনার কারণে আগের তুলনায় তিন ভাগের দুই ভাগ কাজ কমে গেছে। এখন কিছু টুকটাক কাজ পান। তবে সেগুলো আগের তুলনায় অনেক কম। এমন পরিস্থিতিতে ঈদ আর সাধারণ দিন সমান তাঁদের কাছে।
সিলেটের মেডিকেল রোড এলাকায় কাজের জন্য অপেক্ষায় থাকা বিশ্বনাথের বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- ‘বাড়িতে খেতখামারের কাজ করি। অন্যের জমিতে ধান ও সবজি ফলিয়ে কিছু আয় হয়। তবে এখন ধান ও সবজির মৌসুম না। এর মধ্যে এক দিন বা দুদিন পরই ঈদ। বাচ্চারা নতুন কাপড় কেনে দেওয়ার আবদার করেছে। কিন্তু হাতে যা কিছু টাকা আছে, সেটি দিয়ে বাচ্চাদের কাপড় কেনা, ঈদের সেমাই-পোলাও কেনার মতো যথেষ্ট না। এ জন্য কাজের সন্ধানে এখানে এসেছি। তবে এলাকায় দিনমজুরি করি না। সেখানে দিনমজুরি করতে গেলে মানসম্মান থাকবে না।’
শাহজালার উপশহর এলাকায় কাজের সন্ধানে আসা সাহেরা বেগম বলেন- ‘ঘরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামী। ছেলেসন্তানেরা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। এখন আমি আর স্বামী আলাদা থাকি। স্বামীর ওষুধপত্র এবং দুজনে চলার জন্য নিজেকেই সব জোগাড় করতে হয়। মাঝেমধ্যে ছেলের ঘর থেকে ভালো কিছু রান্না করলে আমাদের দেয়।’ কিন্তু অন্যের কাছে না চেয়ে নিজের রুজির টাকাই সংসার চালাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বলে জানান তিনি। তবে করোনায় কাজকাম একেবারে কমে গেছে। এক দিন কাজ করলে পাঁচ থেকে সাত দিন বসে থাকতে হচ্ছে। (প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত)