রোজিনা ইসলাম গ্রেফতারের আইন নিয়ে সরকার ও সাংবাদিকদের ভিন্ন অবস্থান
সময় সংগ্রহ :
কাদির কল্লোল, (ঢাকা থেকে) : প্রথম আলো’র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নথি চুরির যে অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করেছে, তার সমর্থনে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্য অধিকার আইনের কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- লুকিয়ে এসব তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল না।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্য সাংবাদিকদের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে বুধবারও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সাংবাদিকরা বিক্ষোভ করেছেন।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এখন কারাগারে রয়েছেন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা মামলায়। সেই মামলায় রাষ্ট্রীয় নথি চুরি এবং অনুমতি ছাড়া ছবি নেয়া ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত সোমবার রোজিনা ইসলামকে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার কক্ষে আটকে রাখার পর তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনার ঘটনা নিয়ে সাংবাদকিরা প্রশ্ন তুলেছেন।
সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত মঙ্গলবার মামলায় উত্থাপিত অভিযোগ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
এরপর বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে গোপনীয় বিষয় প্রকাশযোগ্য নয়। “সাংবাদিকগণের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। এভাবে লুকিয়ে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল না,” বলেন তিনি।
সাংবাদিকদের অনেকে বলেছেন- শত বছরের পুরোনো আইনে মামলায় তথ্য চুরির যে আভিযোগ আনা হয়েছে, সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে।
সরকারের এমন অবস্থান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরুপ বলে মনে করেন সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ। তিনি বলেছেন- “আসলে সরকার আবেগের বশে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে- বিষয়টা তা নয়। কেননা মামলা করার আগে যে পাঁচ ঘন্টা সময় তারা নিয়েছে, তখনই তারা নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা আইনের আশ্রয় নেবে রোজিনার বিরুদ্ধে।”
মোস্তফা ফিরোজ আরও বলেছেন- “জনাব ওবায়দুল কাদের যেটি বলেছেন, তিনি নিজেও জানেন যে ১৯২৩ সালে এই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত গুপ্তচরদের ক্ষেত্রে, এটা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে নয়। কোন সাংবাদিককে যদি অনুসন্ধানী রিপোর্ট বা বিশেষ রিপোর্ট করতে হয়, তখন তাকে নানান কৌশলে তথ্যগুলো নিতে হয়।” “এটা বহুদিনের রীতি, নতুন কিছু নয়। সুতরাং আজকে ওনারা যে সব কথা বলছেন, তারা এর মাধ্যমে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন,” বলেন মোস্তফা ফিরোজ।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেছেন- তথ্য অধিকার আইনে অবাধ তথ্য পাওয়ার কথা যখন বলা হয়, তখন অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের ব্যবহার সাংঘর্ষিক হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন- একজন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টকে তথ্যতো নানাভাবে সংগ্রহ করতে হয়। আমরা অনেক বড় বড় ঘটনার কথা জানি। ওয়াটার গেটে কেলেঙ্কারির কথা জানি।”
“এখন যে কথাটা তারা বার বার বলছে যে গোপনীয় তথ্য, অতি গোপনীয় তথ্য। অতি গোপনীয় তথ্য সম্পর্কে আমরা জানি, সেটা হচ্ছে, যদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরুপ বা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরুপ কোন তথ্য যদি প্রকাশ পায়,” বলেন ফরিদা ইয়াসমিন।
তিনি আরও বলেছেন- “এখন প্রশ্নটা হলো যে কী বিষয়, কী তথ্য মানে এটা কত গোপনীয় ছিল-এটা কী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ-এ বিষয়গুলো আসলে জানার আছে।”
“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকার কি আমাদের ভাষা বুঝতে পারছেন না-আমি জানি না,” বলেন তিনি।
ঢাকার বাইরে জেলা উপজেলা পর্যায়েও সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিভিন্ন সমস্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। সিলেট থেকে সেখানকার প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী বলেছেন- জেলা-উপজেলা পর্যায়েও দুর্নীতি বা অনিয়মের খবর সংগ্রহ করতে সাংবাদিকদের সবসময় নানা কৌশল নিতে হয়। কিন্তু এখন মন্ত্রীদের অনেকে যে সব বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন।