সাড়ে তিন ঘন্টায় ৬ ঝাঁকুনি : দুই ফল্টের মধ্যখানে থাকা সিলেট বিপদে
স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে ঘন ঘন ভূমিকম্প নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ডেঞ্জার জোন হিসেবে চিহ্নিত সিলেটে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে পরপর ছয় বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। স্মরণকালে এমনটি হয়নি।
শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে প্রথম দফা অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের সময় অনেক বাসা-বাড়ি ও কর্মস্থল থেকে বের হয়ে খোলা স্থান ও সড়কে চলে আসতে দেখা যায়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ১০টা ৫১ মিনিটে, বেলা সাড়ে ১১টা ও ১১টা ৩৪ মিনিটে সিলেট অঞ্চলে আবারো মৃদু ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। সর্বশেষ বড় ঝাঁকুনি অনুভূত হয় দুপুর ২টায়। এ নিয়ে সিলেটে মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভূবিজ্ঞানীদের মতে- ছোটখাটো ভূমিকম্প তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে ছোট ছোট ভূমিকম্প বড়ো মাত্রার ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ।
এদিকে ছয় দফার এই ভূমিকম্প কেবল সিলেটে অনুভূত হয়েছে। আর কোথাও হয়নি। তবে এসব কম্পনে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা যীশু তালুকদার।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ঢাকার তথ্য অনুযায়ী- রিখটার স্কেলে শনিবার সকাল ১০.৩৬ মিনিটে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩। সকাল ১০.৫০ মিনিটে ভূমিকম্পের মাত্রা ৪.১। এরপর ১১.৩০ মিনিটে হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ২.৮। এছাড়া ১১টা ৩৪ মিনিটের ভূমিকম্পের মাত্রা ২ এর নিচে হওয়ায় সেটা গণনায় নেয়া হয়নি। এছাড়া দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে ফের ৪ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। এরপর ২টায় আবারও ভূমিকম্প হলেও সেটা রিখটার স্কেলে ২ মাত্রার নিচে হওয়ায় গণনায় নেয়নি আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের জৈন্তা।
এর আগে ২৮ এপ্রিল সকাল ৮টা ২২ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো। যার উৎপত্তি স্থল ছিলো ভারতের আসামে এবং রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিলো ৬।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম জানান- পরপর এতোবার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চলের পাশেই ডাউকি ফল্ট অঞ্চলের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এতো কম সময়ের মধ্যে কয়েক দফা ভূ-কম্পন হওয়ায় আগামী সাতদিন নগরবাসীকে সচেতন থাকার আহবান জানান তিনি।
জানা যায়, উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’, দক্ষিণে ‘শাহবাজপুর ফল্ট’। এ দুই ফল্টের মধ্যখানে থাকা সিলেট আছে বিপদে। এই বিপদ যেকোনো সময় ধেয়ে আসতে পারে ভয়ানক হয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে- ভূমিকম্পের জন্য বিপজ্জনক এলাকা সিলেট। সিলেট থেকে মাত্র ২শ’ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ডাউকি ফল্টের (ভূগর্ভস্থ প্লেটের ফাঁক) অবস্থান। অন্যদিকে শাহবাজপুর ফল্টও সিলেটের কাছাকাছি (এটি হবিগঞ্জ-কুমিল্লা এলাকাধীন)। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুবই বেশি।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী বলেন- সিলেটে ৪ বার ভূমিকম্প হয়েছে। ঢাকা আবহাওয়া অধিদপ্তর ৬ বার ভূমিকম্পের কথা জানালে তারা কেন ৪ বার বলেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- রিখটার স্কেল ২ মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হলে সেটি সিলেটে ধরা পড়ে না।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছে আর্থ অবজারভেটরি। আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন- সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটেরই জৈন্তা এলাকা। সিলেটের জৈন্তা এলাকার ডাউকি ফল্টেই সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে আমাদের কেন্দ্রে আমরা চিহ্নিত করেছি। ডাউকি ফল্ট পূর্ব পশ্চিমে প্রায় তিনশ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই পলিমাটি দিয়ে ঢাকা’।
ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তার গবেষণা মডেল বলছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান।
তিনি জানান- বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। তবে আজকের প্রথম ভূমিকম্পটি ভালোভাবে বোঝা গেলেও পরেরগুলো ছিলো আরও মৃদু কম্পন অর্থাৎ খুবই হালকা ধরণের।
‘কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দু’টি অঞ্চলে যেভাবে শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে বহুকাল ধরে, তাতে আট মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে যদি একবারে হয়। হলে একবারেও হতে পারে আবার ভেঙ্গে ভেঙ্গে বা দফায় দফায়ও হতে পারে। কিন্তু কোন মাত্রার হবে এটা আগে থেকে অনুধাবন সম্ভব না।’
আখতার বলেন- বারবার যেভাবে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়েছে তাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বড় ধরণের কম্পনও অনুভূত হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। ১৯৫০ সালে যখন আসামে ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল তার পূর্বে এরকম ঘনঘন ভূমিকম্প হয়েছিল।’