কোম্পানীগঞ্জের রাজনীতি: দুই ভাইয়ের সাক্ষাতের পরও সংঘাত কেন
বিশেষ সংবাদদাতা :
২০২০ সালের ৩১ মার্চ। জাতীয় নির্বাচন, নিজ দলের দুই সাংসদের ‘অপরাজনীতি’সহ নানা বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন জাতীয় রাজনীতিতে অচেনা মুখ নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। একপর্যায়ে বড় ভাই এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধেও নানা বক্তব্য দিয়ে কোম্পানীগঞ্জের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ান তিনি। এতে স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রতিপক্ষ তৈরি হয়।
২০২১ সালের ২২ মে। সাড়ে চার মাস পর রাজধানীর ধানমন্ডিতে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ছোট ভাই কাদের মির্জার। সাক্ষাৎ শেষে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে কাদের মির্জা ‘সকল গ্লানি ভুলে’ শান্তির কোম্পানীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
দলীয় সূত্র বলছে-ে কাদের মির্জা লোকজনের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ফোন করে তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করার অনুরোধ করেন। এ অনুরোধ করতে গিয়ে হোঁচট খান তিনি। দলের বিভিন্ন ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা তাঁর সঙ্গে রাজনীতি না করার কথা জানান। কিন্তু দলীয় সূত্রগুলো বলছে- মির্জার ওই ঘোষণার পর কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগে ঐক্য আসেনি। বরং বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাতের পর কাদের মির্জা ‘মনে মনে শক্তি সঞ্চয়’ করেন। এরপর তিনি নতুন ‘উদ্যমে’ এলাকায় ফিরে দলে প্রভাব ফেরানোর চেষ্টা করেন। এতে নতুন করে সংঘাত দেখা দেয়।
দলীয় সূত্র জানায়- বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন কাদের মির্জা ঢাকা থেকে কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটে আসেন। সেদিন তাঁর আগমন উপলক্ষে বসুরহাটে ব্যাপক শোডাউন করেন তাঁর অনুসারীরা। এলাকায় ফেরার পর কাদের মির্জা লোকজনের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ফোন করে তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করার অনুরোধ করেন। এ অনুরোধ করতে গিয়ে হোঁচট খান তিনি। দলের বিভিন্ন ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা তাঁর সঙ্গে রাজনীতি না করার কথা জানান। এতে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন কাদের মির্জা।
কাদের মির্জার ভাগনে ও দলীয় রাজনীতিতে বিপরীত মেরুতে থাকা মাহবুবুর রশিদ বলেন- কাদের মির্জার কাছে খবর ছিল, ওবায়দুল কাদেরের কাছে ক্ষমা না চাইলে স্ত্রী-পুত্রসহ গ্রেপ্তার হতে পারেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কিছুটা নমনীয় হন। ঈদের সময় ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে সায় দেন ওবায়দুল কাদের। এরপর ঢাকায় গিয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বিগত দিনের কর্মকাণ্ডের জন্য ভুল স্বীকার করেন কাদের মির্জা। ওবায়দুল কাদেরও ভাইকে ক্ষমা করে কাছে টেনে নেন।
মাহবুবুর রশিদের দাবি- ওবায়দুল কাদেরের ‘সরলতায়’ কাদের মির্জা মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে এলাকায় এসে নতুন উদ্যমে দল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। ফোনে বিভিন্ন নেতাকে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের ওপরও নানা বিষয়ে চাপ সৃষ্টি শুরু করেন।
স্থানীয় ও দলীয় সূত্র জানায়- গত ২৬ মে চর হাজারী ইউনিয়নের আবু মাঝির হাটে একটি চা-চক্র অনুষ্ঠানে বক্তৃতার একপর্যায়ে কাদের মির্জা দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন প্রতিপক্ষের কেউ তাঁদের একজনকে কিছু করলে, তাদের দুজনকে ধরে হাঁটুর নিচে পেটাতে। ওই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মাথায় বসুরহাটে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জায়দল হক ও মুছাপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করেন কাদের মির্জার অনুসারীরা। এরপর গত শনিবার বসুরহাট পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিপক্ষের ছোড়া গুলিতে কাদের মির্জার সাত অনুসারী গুলিবিদ্ধ হন।
কোম্পানীগঞ্জের রাজনীতিতে মির্জাবিরোধীরা বলছেন- এখানে কেবল দুই ভাইয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। তাই উপজেলার রাজনীতিতে সম্প্রীতি আসেনি।
কাদের মির্জার প্রতিপক্ষ এবং নিজেকে ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান (বাদল) বলেন- কাদের মির্জার অপরাজনীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওবায়দুল কাদের তাঁদের অনুরোধ করেছিলেন একটু তাঁর ইজ্জতটা রক্ষা করার জন্য। তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাঁরা মাঠে নেমেছেন। দলের বেশির ভাগ নেতা–কর্মী এখন কাদের মির্জার বিরুদ্ধে। পাঁচ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী শপথ করেছেন কাদের মির্জার সঙ্গে রাজনীতি না করার। কিন্তু এখন ওবায়দুল কাদের তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে মিলে গেলেন। এখন তাঁদের ফোনও ধরেন না তিনি। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে ফোন করান।
আর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খিজির হায়াত খান বলেন- ‘আমরা আগেই বলেছি কাদের মির্জার সঙ্গে আর রাজনীতি করব না। ওবায়দুল কাদের সাহেব যদি পারেন তাঁর ভাইকে দিয়ে কোম্পানীগঞ্জে রাজনীতি পরিচালনা করতে, করবেন। সেটি তাঁর বিষয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিশ্বাসীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ করব।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেষ্টা করেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
নানাভাবে চেষ্টা করে কথা বলা যায়নি আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গেও। তাঁর অনুসারী ও তাঁর (মির্জা) ঘোষিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইস্কান্দার হায়দার চৌধুরী বলেন- কাদের মির্জার নেতৃত্বে অতীতেও উপজেলা আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ ছিল, এখনো আছে। কিছুসংখ্যক নেতা-কর্মী ভুল পথে গেছেন। কাদের মির্জা তাঁদের আহ্বান জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি করার জন্য। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কাদের মির্জার সাক্ষাতের পর প্রতিপক্ষের লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁরা প্রতিদিনই কাদের মির্জার অনুসারীদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন বলে তাঁর দাবি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- বর্তমান পরিস্থিতিতে ওবায়দুল কাদের চাইলে এক নিমেষেই সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন। তিনি দুই পক্ষকে ডেকে নিয়ে বসলেই কেবল এই সংঘাতের অবসান হতে পারে, না হয় সংঘাত লেগেই থাকবে।