সিলেট গ্যাস ফিল্ডের প্ল্যান্টে বিকট শব্দ : ভূ-কম্পনে বাড়িঘরে ফাটল
স্টাফ রিপোর্টার :
হবিগঞ্জের বাহুবলে সিলেট গ্যাসফিল্ডের অকটেন উৎপাদনকারী কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের বিকট শব্দ ও ভূ-কম্পনে আশপাশের সাত গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
উপজেলার রশীদপুরের বড়গাঁও এলাকায় প্ল্যান্টের কারণে ভূ-কম্পনে সাত গ্রামের বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। দিনরাত বিকট শব্দ ও ভূ-কম্পনের কারণে শিশুদের নানা মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জন্য গত ২৭ মে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা পরিষদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগী গ্রামগুলোর বাসিন্দারা।
বিকট শব্দ ও ভূ-কম্পনের প্রভাব আশপাশের অন্তত ১২টি গ্রামের মধ্যে অনুভূত হয়। সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় ঘটছে বড়গাঁও, শাহানগর, রশীদপুর, অলিপুর, চক্রামপুর, শফিয়াবাদ ও সাহাপুরে।
বাহুবল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন- ‘গ্রামবাসীর অভিযোগ পাওয়ার পর আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ভয়াবহ চিত্র। কৃত্রিম ভূমিকম্পের কারণে গ্রামের বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। পরে বিষয়টি সমাধানের জন্য কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।’
শাহানগর গ্রামের বাসিন্দা টিপু দেব জানান- বাহুবল উপজেলার রশীদপুরের বড়গাঁও এলাকায় কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের ‘ক্যাটালাইটিক রিফরমিং ইউনিট’ চালু করা হয় গেল বছরের শেষের দিকে। চালুর শুরুর দিকে শব্দ স্বভাবিক মাত্রায় ছিল। গত ৮ এপ্রিল সেখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের থেকে ‘ক্যাটালাইটিক রিফরমিং ইউনিট’-এ শব্দের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করে। এ ছাড়া ইউনিটের আশপাশে কৃত্রিম ভূ-কম্পন সৃষ্টি হয়।
তিনি জানান- ২৪ ঘণ্টা ক্যাটালাইটিক রিফরমিং ইউনিট চালু থাকার কারণে শব্দ ও ভূ-কম্পন হতে থাকে অবিরাম। রাতে ইউনিটে উচ্চমাত্রায় প্রেসার দেয়ার কারণে শব্দ ও ভূ-কম্পনের মাত্রাও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
অব্যাহত ভূ-কম্পনের কারণে প্ল্যান্টের আশপাশের গ্রামগুলোর জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে কাঁচা-পাকা বাড়িঘরে।
শফিয়াবাদ গ্রামের তৈয়ব আলী বলেন- ‘দিনের বেলা শব্দ আর ভূমিকম্প কিছুডা কম থাকলেও রাতে বেশি হয়। মাঝে মাঝে মাঠি এমনভাবে কাঁপে, সারারাইত ঘুমানো যায় না। বাচ্চা-খাইচ্ছা নিয়া জাইগা থাকা লাগে। পুলা-পুরি (ছেলে-মেয়ে) লেখাপড়া করতে পারে না। এই অবস্থার মাঝে আমরা আছি।’
বড়গাঁও গ্রামের গৃহবধূ স্বপ্না দেব বলেন- ‘রাতে যখন বাচ্চা-খাচ্ছা নিয়ে ঘুমে থাকি। হডাৎ কইরা বাচ্চায় ছিল্লি (চিৎকার) দিয়া ঘুম থাইক্কা উইট্টা (উঠে) আনজা দিয়া (জড়িয়ে) ধরে। শব্দ আর মাটির কাঁপনে বাচ্চা পুলাপানের (শিশুদের) বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতাছে। আমরা অসহায় মানুষ কিতা করমু কুছতা (কিছু) বুঝতাছি না। সরকার যেন আমরারে এই অবস্থা থাইক্কা মুক্তি দেয় ইডাই চাই।’
একই গ্রামের কলেজ ছাত্র আবির দেব বলেন- ‘কনডেনসেটের শব্দে ও কৃত্রিম ভূমিকম্পনের কারণে বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। কখন ঘর ভেঙে পড়ে, কে ঘরের নিচে চাপা পড়ে, এই আতঙ্কে আমাদের দিন কাটছে। এখানে আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ভাদেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমান বলেন- ‘আমরা গ্রামের মুরব্বিদের নিয়ে প্ল্যান্টের শব্দ ও ভূ-কম্পনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন, এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল এখনও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
তিনি বলেন- ‘আগে শব্দ বা কম্পন ছিল না। প্ল্যান্টে আগুন লাগার পর থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই মনে হচ্ছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এটি হতে পারে। কর্তৃপক্ষ চাইলেই এর সমাধান করতে পারবে।’
গ্রামবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান- বাহুবল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা তালুকদার ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো পরিদর্শন করেছেন। তারা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন বলে গ্রামবাসীকে আশ্বাস দেন।
বাহুবল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন- ‘এ ব্যাপারে তাদের কোনো নোটিশ না দিতে এক কর্মকর্তা ফোন করেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি আমাকে হুমকি দিয়েছেন। তবে আর কয়েক দিন অপেক্ষা করব। এর মধ্যে সমাধান না হলে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাদের নোটিশ দেয়া হবে।’
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন- ‘লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসেছি। এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট গ্যাসফিল্ডের আওতাধীন কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।