জল-কাঁদায় একাকার বিমানবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস : দুর্ভোগে কয়েকলাখ মানুষ
সময় সংগ্রহ :
আহমদ ইমরান : সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে বাদাঘাট বাইপাস সড়ক চারলেন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বেশ আগে। চলছে নকশা প্রস্তুতের কাজও। বিষয়টা সিলেটবাসীর জন্য আশার খবর। তবে যে রাস্তা নিয়ে সিলেটবাসীর আশার সঞ্চার, দীর্ঘদিন থেকেই সংস্কারবিহীন অবস্থায় সেই রাস্তাটিই এখন জল-কাঁদায় একাকার। হয়ে পড়ে একেবারে চলাচলের অনুপযোগী। আর এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন কয়েক লাখ মানুষ।
১২ দশমিক ৭ কিলোমিটার এই সড়কের বেশিরভাগ অংশই ভেঙে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ভাঙাচোরা আর ধুলো উপেক্ষা করে চলাচল করতে পারলেও বর্ষার শুরুতেই তা থমকে যায়। এমন বাস্তবতায় কোথাও পিচ ঢালাইয়ের চিহ্ন নেই, কোথাও আছে শুধুই কংক্রিট। সড়কের বেশিরভাগ অংশে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে সড়কের বেশিরভাগ অংশেই পিচ ঢালাই কিংবা কংক্রিটের ছিটেফোটাও নেই, আছে কাঁদা জল। নেই পায়ে হেঁটে যাবার মতো অবস্থাও। এমন অবস্থায় স্থানীয়দের কাছে ‘চারলেন সড়কের স্বপ্নই’ এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়- বিমানবন্দর-বাদাঘাট সড়কটিতে বাইশটিলা ছোট ব্রিজের পর থেকেই ভাঙন শুরু। ব্রিজ থেকে নামার পরপরই সড়কে পিচ ঢালাইয়ের দেখা মিলে না। আর সড়কটি দেখেও বুঝা যায় না এটি আগে কখনও পিচ ঢালাই ছিল। কারণ সড়কের কোথাও ঢালাইয়ের চিহ্নও নেই। এরপর বাদাঘাট বাজার পর্যন্ত সড়কের মাঝেমধ্যে ঢালাইয়ের দেখা মিললেও তা শুধু মানুষের কষ্টই বাড়ায়। সড়কটির বেশিরভাগ অংশই মানুষের চলাচলের অনুপযোগী। এরমধ্যে বেশ কিছু জায়গায় গেল বৈশাখে স্থানীয়রা ধান শুকিয়েছেন। এসব ধান এবং খড় রাস্তায় পচে দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। সেখানেই খড় বেশি পরিমাণে ছিল সেখানে সড়কের অস্তিত্বও নেই। পঁচা খড় আর বৃষ্টির পানি জমে এসব স্থানে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এসব গর্তেও কারণে এই সড়ক দিয়ে গাড়ি তো দূরের কথা মানুষও চলা দায়।
স্থানীয়রা বলছেন- ‘সড়কটি নির্মাণের পর থেকেই আর সংস্কার হয়নি। সেজন্য সড়কের বেশিরভাগ অংশেই বড়বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে শুষ্ক মৌসুমে কোনমতে চলাফেরা করা গেলেও বর্ষাও শুরু থেকে তাও হচ্ছে না। এতে করে স্থানীয়রা কষ্ট বেশি করছেন। এলাকার মানুষের যাতায়াতের অন্যতম এ সড়কটির বেহাল দশায় রোগী ও বিশেষ প্রয়োজনে গাড়ির প্রয়োজন হলেই ভোগান্তি শুরু হয়। সড়কটি দিয়ে কোন গাড়িই প্রবেশ করতে চায় না। আর এলেও গুনতে হয় বাড়তি ভাড়া। সেজন্য সড়কটি দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। চারলেন হোক আর দুই লেন এসব তো পরের বিষয়। আগে তো মানুষ বাঁচতে হবে।’
স্থানীয় মানুষের দাবির সাথে একমত পোষণ করে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন- ‘এই সড়কটি করার জন্য আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছি। আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহোদয় বলতেন- ‘সড়কটি আশফাকের কারণে হচ্ছে’। অথচ এই সড়কটিই এখন বেহাল অবস্থায় রয়েছে। আমরা বারবার বলছি সড়কটি সংস্কার করে মানুষের চলাচলের উপযোগী করে দেয়ার জন্য। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এখন সড়কটির চার লেন হচ্ছে। এটি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মহোদয় দেখভাল করছেন। আশাকরি দ্রুত কাজটি শেষ হবে। তবে একই সাথে সড়কটি সংস্কার করে যেন দ্রুত মানুষের চলাচলের উপযোগী করে দেয়া হয়। আমরাও আগামী মিটিংয়ে এ বিষয়ে কথা বলবো।’
এর আগে ১৯৯৯ সালে সড়কটি নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই আশায় বুক বেধেছিলেন চেঙ্গেরখাল নদীর তীরবর্তী মানুষেরা। শহরের সাথে দ্রুত যোগাযোগ আর উন্নত জীবনের স্বপ্নও শুরু হয়। একই সাথে শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর। সেই অপেক্ষার প্রহর ফুরায় ২০১০ সালে। ২০১০ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ (সদর) আসনের এমপি আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাইপাস সড়ক নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। একই বছরে সিলেটে নতুন কারাগার নির্মাণ ও স্থানান্তরের প্রকল্প একনেকে পাস হয়। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাদাঘাট এলাকায় চেঙ্গেরখাল নদীর তীরে ৩০ একর জমির এই কারাগার নির্মাণের ঘোষণা দেন।
এরপরই মূলত আশা বাড়ে স্থানীয়দের। নতুন জেল নির্মাণের সাথে সড়কের কাজ শুরু হওয়ায় ‘নতুন দিনের গান’ শুরু হয় তাদের জীবনে। তবে সেই নতুন গান বেশি দিন চলে না। কারণ নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ফেরত যায় বরাদ্দ। বন্ধ হয়ে যায় সড়কের কাজও।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে- ২০১০ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাইপাস সড়ক নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। মোট ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সড়কটি দুই লেন কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তবে সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় সড়কের বরাদ্দ টাকা ফেরত যায়। এরপর আবার ২০১৪ সালে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আংশিক কাজের পর সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে সময়ে ব্যবধানে পাথরবাহী ট্রাকের চলাচল, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী ও তাদের স্বজনদের আসা-যাওয়া, বঙ্গবন্ধু আইসিটি পার্কে যাতায়াত, পর্যটকবাহী যানবাহনের জন্য সহজ যাতায়াত সুবিধা এবং বিমানবন্দর ও বাদাঘাট এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিক বিবেচনায় বাইপাস সড়কের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে সিলেটের সচেতন মহল থেকে বাইপাস সড়কটি চার লেন করার দাবি ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে বিমানবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস সড়কের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে চার লেনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালে সেই প্রস্তাব সংশোধন করে চার লেনের সঙ্গে দুটি সার্ভিস লেন যুক্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে সিলেট-১ আসনের এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ নিয়ে সড়ক বিভাগকে চিঠিও দেন। তার এই চিঠির প্রেক্ষিতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম-প্রধান জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট সিলেট সফর করেছিলেন একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।
প্রতিনিধি দলটি, বিমানবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস সড়কের সড়কের ১২ কিলোমিটার এলাকা পরিদর্শন করেন। ফোর লেনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে স্থানীয়দের সঙ্গেও তারা কথা বলেন। পরে তারা সিলেটের জনপ্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। সিলেটে সফরকালে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন- আগামী তিন মাসের মধ্যে তারা এই সড়ক নিয়ে রিপোর্ট দাখিল করবেন। এরপর সেটি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সিলেট থেকে ঘুরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট ওই সড়কের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদন প্রদান করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) মো. জাকির হোসেন।
প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন- সড়কে যানবাহন চলাচল ও ট্রাফিক বিবেচনায় কমিটির কারিগরি সদস্যদের মতামত অনুযায়ী সড়কটি দুই লেনে নির্মাণ করলেই বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে। তবে ভবিষ্যতে ‘প্রয়োজনীয়তা বিবেচিত হলে’ এটিকে চার লেনে উন্নীত করার বিষয়টি ‘বিবেচনা করা যেতে পারে’। এ জন্য এখন চার লেনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন- বিমানবন্দর-বাদাঘাট বাইপাস চারলেন সড়কের নকশা ডিজাইনের কাজ চলছে। আশাকরছি দ্রুতই নকশা প্রস্তুত হয়ে যাবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে আমরা প্রকল্পটি একনেকে প্রেরণ করবো। একনেকে প্রকল্পটি পাশ হলেই দ্রুত টেন্ডার আহবান করা হবে। সেজন্য সড়কটি নিয়ে বর্তমানে কোন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে না। তবে সড়কটি মানুষের চলাচলের উপযোগী করে দেয়ার জন্য সংস্কার করা যেতে পারে। এটি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবো।
এ ব্যাপারে সিলেট সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন- ‘চার লেনের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ফলে সড়কটি নিয়ে আপাতত কোন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে না। তবে সড়কটি সংস্কারের জন্য আমরা কাজ শুরু করবো। কয়েকদিনের মধ্যেই সংস্কার কাজ শুরু হবে। আর অতিরিক্ত সচিব মো. জাকির হোসেন স্যারও আমাকে সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, কারণ তিনিও সড়কটি সম্পর্কে অবগত আছেন। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা সংস্কার কাজ শুরু করবো।’