‘সবচেয়ে কঠোর’ লকডাউনের মুখোমুখি বাংলাদেশ
সময় সিলেট ডেস্ক :
পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে কঠোর লকডাউন সাময়িক শিথিল অবস্থার মেয়াদ পিছিয়ে ২৭ জুলাই করার যে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল তা ভিত্তিহীন বলে আগেই জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
আর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন- ‘শাটডাউনের পূর্বের ঘোষণাই চূড়ান্ত। তবে ঢাকায় ফেরার ক্ষেত্রে শুক্র ও শনিবার কিছুটা ছাড় দেয়া হতে পারে। কিন্তু রোববার থেকে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া চলাচল করতে দেয়া হবে না কাউকে।’
তবে সব শেষের সত্য হলো শুক্রবার (২৩ জুলাই) থেকে শুরু হচ্ছে ‘সবচেয়ে কঠোর লকডাউন’। বৃহস্পতিবার দুপুরে গণমাধ্যমের কাছে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন- গতবারের চেয়ে কঠিন হবে এ বিধি-নিষেধ। এটি বাস্তবায়ন করতে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। এ সময় অফিস-আদালত, গার্মেন্ট-কলকারখানা সবকিছুই বন্ধ থাকবে।
সব মিলিয়ে শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে ফের ‘সবচেয়ে কঠোর’ লকডাউনের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বাস্তবতা কতোটুকু কঠোর হবে তা নির্ভর করছে প্রশাসনের গতি-প্রকৃতির উপর। শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত চলমান থাকবে এই কঠোর অবস্থা। এ বিষয়ে ১৩ তারিখ মন্ত্রিপরিষদের প্রজ্ঞাপনেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
লকডাউনের কঠোরতা বুঝাতে গিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন- ‘যারা গ্রামে গিয়েছে, তারা জানে যে সব বন্ধ থাকছে। তাদের কর্মক্ষেত্রও বন্ধ থাকছে। তারা সময় নিয়েই গেছে। আমি বলব- তারা যেন পাঁচ তারিখের পরেই আসে। এখন তাদের আসার প্রয়োজন নেই।’
ফরহাদ হোসেন বলেন- এই ১৪টা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে আমাদের আহ্বান, মানুষ ঘরে থাকবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসা যাবে না। ঘরের বাইরে আসলে অবশ্যই ডাবল মাস্ক পরবে। যদি এটা করতে পারি ১৪ দিনের জন্য তাহলে আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব। না হলে তা বাড়তে থাকবে। হাসপাতালে রোগীর চাপ কমাতে আমাদের অসুবিধা হবে।
দেশে করোনা সংক্রমণ রোধে গত ১ জুলাই থেকে টানা দুই সপ্তাহ শাটডাউনের পর কোরবানি ঈদ ও পশুর হাট আর ঘরমুখী মানুষের নির্বিঘ্ন যাত্রা বিবেচনায় ১৫ জুলাই থেকে তা শিথিল করে সরকার। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে তখনই জানিয়ে দেওয়া হয়, ২৩ তারিখ ভোর থেকে আবার ১৪ দিনের শাটডাউন দেওয়া হবে। কাল থেকে তা শুরু হবে।
মানতে হবে ২৩ নির্দেশনা :
লকডাউন বাস্তবায়নে এবার ‘সবচেয়ে কঠোর’ হওয়ার কথা জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এছাড়া মানতে হবে ২৩টি বিধিনিষেধ। বিধিনিষেধ হচ্ছে-
- ১. সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
- ২. সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমান’সহ) ও সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
- ৩. শপিংমল/মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
- ৪. সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে।
- ৫. সব ধরনের শিল্প-কলকারখানা বন্ধ থাকবে।
- ৬. জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক [বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি],
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। - ৭. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
- ৮. ব্যাংকিং/বিমা/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
- ৯. সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন এবং দাফতরিক কাজ ভার্চুয়ালি (ই-নথি, ই-মেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যম) সম্পন্ন করবেন।
- ১০. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন-কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন/বিক্রয়, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান কার্যক্রম, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলী, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ভিসা সংক্রান্ত কার্যক্রম, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়কের বাতি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যক্রম), সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ফার্মেসি ও ফার্সাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে।
- ১১. বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় খোলা রাখার বিষয়ে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
- ১২. জরুরি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক/লরি/কাভার্ড ভ্যান/নৌযান/পণ্যবাহী রেল/ফেরি এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
- ১৩. বন্দরগুলো (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিস এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
- ১৪. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন/বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
- ১৫. অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
- ১৬. টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে।
- ১৭. খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।
- ১৮. আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট/প্রমাণ প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহারপূর্বক যাতায়াত করতে পারবেন।
- ১৯. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেবে।
- ২০. ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
- ২১. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি/কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেসঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
- ২২. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখাক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
- ২৩. সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
বিধিনিষেধে বন্ধ থাকছে ট্রেন :
ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিধিনিষেধ চলাকালীন সড়ক, নৌ, রেলপথে সব ধরনের যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রান্সপোর্টেশন শাখা থেকে জানানো হয়- করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ঈদের ছুটির পর সরকার আবারও কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। অর্থাৎ ২৩ তারিখ সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত রেলওয়ের সব যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ থাকবে। তবে কন্টেইনার, খাদ্য, পণ্যবাহী ও বিশেষ পার্সেল ট্রেন চলাচল করবে।
আরও জানানো হয়- পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে। এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হচ্ছে-
- ১. সকল রেলওয়ে কন্ট্রোল অফিস সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে।
- ২. সকল কর্মকর্তা/কর্মচারী স্ব-স্ব হেড কোয়ার্টারে অবস্থান করবেন।
- ৩. সরকারের নির্দেশে যেকোনো সময় ট্রেন পরিচালনার প্রস্তুতি থাকতে হবে।
- ৪. নিরাপত্তার স্বার্থে রেলপথ এবং কোচগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলমান থাকবে ও রেলওয়ে স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথারীতি অব্যাহত রাখতে হবে।
- ৫. কন্টেইনার, খাদ্যসহ জরুরি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল অব্যাহত থাকবে।
- ৬. প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য, সবজি ও অন্যানা জরুরি পার্সেল মালামাল পরিবহনের জন্য বিশেষ পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে।
বন্ধ থাকবে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট :
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঈদের ছুটি শেষে ২৩ জুলাই থেকে সরকার কঠোর বিধিনিষেধে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
সম্প্রতি জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকাল থেকে ৫ আগস্ট রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। সার্কুলারটি জারি করেন বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী এম জিয়া উল কবির।
সার্কুলারে বলা হয়েছে- সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। তবে ত্রাণ-সাহায্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটগুলো অনুমতি নিয়ে চলাচল করতে পারে। সেক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
এর আগে গত ১ জুলাই থেকে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ১৪ জুলাই (বুধবার) মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই (শুক্রবার) সকাল ৬টা পর্যন্ত আরোপিত সব বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল সরকার। শুক্রবার থেকে আবারও জারি করা হয় বিধিনিষেধ।