আফগানিস্তানের অর্ধেক এলাকা কীভাবে দখল করল তালেবান
আন্তর্জাতিক সময়
আফগানিস্তানে ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান। কিন্তু সেই তালেবান এখন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়- আফগানিস্তানের অর্ধেক এলাকা এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।
গত দুই মাসে আফগানিস্তানের অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান, যা ২০০১ সালে পর যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। বিবিসির আফগান সার্ভিসের গবেষণা উঠে এসেছে- গজনি, মাইদান ওয়ার্দাক’সহ আফগানিস্তানজুড়ে এখন সরব উপস্থিতি তালেবান যোদ্ধাদের। এ ছাড়া কুন্দুজ, হেরাত, কান্দাহার ও লস্কর গাহসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে তালেবান।
তালেবানের কোনো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অর্থ হলো, সেখানকার প্রশাসনিক কেন্দ্র, পুলিশ দপ্তর ও সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকা।
আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন’সহ জঙ্গিসংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিয়েছিল তালেবান। আর আল-কায়েদা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল। এ হামলার জেরেই আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাহিনী, তাদের সামরিক জোট ন্যাটো ও আঞ্চলিক মিত্রদের হামলার মুখে ২০০১ সালের নভেম্বরে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান।
তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক মহলের উপস্থিতি বাড়ে। আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। শত শত কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যেও দেশটির প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় তালেবান আবার সংগঠিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে নিজেদের শক্তি বাড়াতে থাকে তারা।
আফগানিস্তানের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলের হেলমান্দ, কান্দাহার, উরুজগান, জাবুল প্রদেশে ঐতিহ্যগতভাবেই তালেবানের অবস্থান শক্তিশালী। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা ফারিয়াব ও বাদাখশানেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী।
২০১৭ সালে বিবিসির এক গবেষণায় উঠে আসে, আফগানিস্তানে কিছুসংখ্যক জেলা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। গবেষণায় এ-ও উঠে আসে, দেশটির আরও অনেক এলাকায় তালেবান সক্রিয়। তারা কিছু এলাকায় সপ্তাহ বা মাস ভিত্তিতে হামলা বাড়াচ্ছে। ওই সময়ই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, পূর্বধারণার চেয়ে তালেবানের শক্তি বেশি।
কিন্তু সে অবস্থাও এখন বদলে গেছে। এখন নতুন নতুন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে তালেবান। কোনো কোনো এলাকা থেকে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী পালিয়েছে। কোনো কোনো এলাকা ছাড়তে সরকারি বাহিনী বাধ্য হয়েছে। আবার সরকার বিভিন্ন এলাকায় তাদের বাহিনী বা মিলিশিয়া পুনরায় মোতায়েন করতেও সক্ষম হয়েছে। কিছু কিছু এলাকা আফগান বাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় এখনো লড়াই চলছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন মার্কিন বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য আফগানিস্তান ছেড়ে গেছেন। শুধু কাবুলে নিরাপত্তার জন্য কিছু সেনা রয়ে গেছে। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ার প্রেক্ষাপটে কিছুদিন ধরে তালেবানের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাচ্ছে মার্কিন বিমানবাহিনী।
এখন আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে সেসব শহর ও জেলা রয়েছে, যেগুলো মূলত সমতলে ও নদীতীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এসব এলাকায় বেশির ভাগ মানুষ বাস করে। আর তালেবান যেসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, সেসব এলাকায় মানুষ কম। এমন অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে জনঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ৫০ জনের মতো। তালেবানের অগ্রযাত্রার মুখে আফগান সরকার বিপদে আছে। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব বড় শহরে সেনা উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। তালেবান ঠেকাতে মাসব্যাপী রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে।
আফগানিস্তানের অনেক শহর তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার হুমকিতে আছে। যেমন: হেরাত ও কান্দাহার শহরের খুব কাছাকাছি তালেবানের চলে আসার খবর পাওয়া যায়।
তালেবানের অগ্রযাত্রা শুরুর পর দেশটিতে সহিংসতা বেড়েছে। বেড়েছে মৃত্যু। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আফগানিস্তানে সহিংসতায় রেকর্ডসংখ্যক সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশটিতে সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতায় ১ হাজার ৬০০ জন মারা গেছে। এই প্রাণহানির জন্য তালেবান ও সরকারবিরোধীদের দায়ী করা হয়েছে।
সংঘাত-সহিংসতার কারণে অনেক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। দেশটিতে চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কুন্দুজ, বালখ, বাঘলান, তাখার, বাদাখশান প্রদেশে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বাড়ছে। কারণ, এসব প্রদেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলো তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব এলাকার অনেক গ্রামের বাসিন্দারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলে যাচ্ছে। কদিন পর কেউ ফিরে আসছে। অনেকে আবার ফিরছে না।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়- তালেবানের হামলার মুখে আফগান বাহিনীর সদস্য’সহ অনেকে দেশ ছেড়ে তাজিকিস্তানে পাড়ি জমাচ্ছে।
আফগানিস্তানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত–ক্রসিংও তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ফলে, সীমান্ত দিয়ে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি তালেবান নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে কী পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তার সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি। সীমান্ত–ক্রসিং দিয়ে পণ্য সরবরাহের ফলে কেমন আয় হয়, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ইরানের সঙ্গে লাগোয়া আফগানিস্তানের ইসলাম কালা সীমান্ত থেকে সরকার মাসে দুই কোটি মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম। তালেবান এমন ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় আমদানি-রপ্তানির প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্য’সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে গেছে।