শাহেদ শাহরিয়ারের কবিতা : স্বদেশ-স্বজাতি-সময় : ইফতেখার শামীম
সময় সাহিত্য
কবিতায় কিংবা শিল্পে সময়কে ধারণ করা মানুষের সভ্য জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দাম্ভিক, যুদ্ধ-জীবনকেন্দ্রীক সময়কে ধারণ করেছেন হোমার, তাঁর ইলিয়ট-অডিসি মহাকাব্যে। কালিদাসের মেঘদূতে বিবরিত হয়েছে বিজয়ী আর্যদের দিনযাপনচিত্র। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে কবি জানাচ্ছেন- “হাঁড়িত্ ভাত নাই, নিতি পড়বেশি”। মধ্যযুগে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী দেবীলক্ষীর কাছে প্রার্থনা করছেন- “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।
ব্রিটিশ যুগে ঝিমিয়ে পড়া ভারতবাসী যখন নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধালো, নজরুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন, ভুল পথে হলেও এই জাতি জেগে উঠেছে। তিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে কবি রফিক আজাদ অভূক্ত ইতর ভাষায় হুঙ্কার দিলেন- “ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো”।
এই যে কলমের বড়শী দিয়ে সময়কে তার নিরন্তর বয়ে চলার নদী থেকে স্তব্ধ কালো অক্ষরে থামিয়ে দিলেন কবি, তা তো শুধু থামিয়ে দেয়া নয় কিংবা শুধু সময়কে ধারণ করাও নয়, বরঞ্চ অশ্রু ও রক্তপাতে নতুন প্রপাত যুক্ত করাও বটে।
কবি শাহেদ শাহরিয়ার নব্বই এর দশকে কবিতাচর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ব্যাংকার জীবনের প্রতিকূলতায় যুগ-পেরোনো দীর্ঘ সৃষ্টিহীনতার পর আবার ফিরে এসেছেন কবিতায়।
তাও এমন এক ফেরা যার প্রথম ধীরস্থির পদচ্ছাপেই সময় সংঘাত, সংকট এবং সংকটের গায়ে বেত্রাঘাত পাঠকমূলে স্বল্পমাত্রার কিন্তু ক্রমাগত ভূমিকম্পের মতো আলোড়ন জাগিয়েছে। স্বদেশ চেতনা, স্বজাতির উন্মূলতা এবং অসহায় সময়ে- তাঁর কবিতাগুলো মুকুন্দরামের আকুতির মতো পাঠকহৃদয়ে বার বার পিতলের ঘন্টাধ্বনি হয়ে বেজে চলেছে।
স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা এবং হৃদয়বেদনা ফুটে উঠেছে তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। জানাচ্ছেন-
“প্রভু হে আপনি সাক্ষীভালোবাসার উৎকৃষ্ট অংশটুকু চিরকালই রেখে এসেছিকেবলই স্বজাতির জন্য”“আমি বলিনি ভালোবাসো কিংবা ভালোবাসতেই হবে বলিনিআমি শুধু আমার ভালোবাসার কথাটুকু জানিয়ে দিতে চেয়েছি…”
‘আকাশস্পর্শী’ কবিতায় বলছেন-
“দেখি আজ কেবলি হীনমন্যতার চাষবাস/অথচ ওয়াহসী বেলাল স্পার্টাকাস/দাসত্বের শৃংখল ছিন্ন করে কতো ক্রীতদাস/ছুঁয়েছে আকাশ!
অল্প কথায় জানাচ্ছেন-
“ভূমিকম্পের মতো/কেবলই হঠাৎ নয়/তোমার জন্য অনুখন/ দোলে এ হৃদয়।”
‘মুখ ঢাকা মুখ’ কবিতায় বলছেন-
“শুধু কার যেন মুখ ঢাকা/মুখে আঁচল।”
‘খিজির দর্শন’ কবিতায় যেন এক মায়ের আকুতি তাঁর-
“তোমার রিজিক বোঝাই কিস্তি, হে প্রিয় স্বদেশহাতিয়ে নিচ্ছে ডাকাত স্বৈরাচারঅথচ কি সাংঘাতিক বেখবর তুমি।”“কিংবা তোমার বাড়-বাড়ন্ত সন্তানেরাযখন যাচ্ছে উচ্ছন্নেআসন্ন যৌবন আগাম বিকিয়ে দিচ্ছেজলের দামেকী ভীষণ উদাসীন তুমি!”
নেতৃত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং আত্মপরিচয় সংকটের এই কঠিন সময়ে কবি বার বার ফিরে গেছেন পুরাণের জুলকারনাইনের কাছে-
“কিংবা জুলকারনাইনের কথাই যদি বলি:আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতে চাইএকটা জাতির নিরাপত্তা সুনিশ্চিতের জন্যকোনটা বেশি জরুরি-সীমান্তে একটি মজবুত প্রাচীরনাকি একজন ন্যায়দৃষ্টির দরদী শাসকপেছনে যার ঐক্যবদ্ধজাতি?” (দ্বিতয়)
“একটি স্নিগ্ধ ভোরের জন্য/একমুঠো মিষ্টি রোদ্দুরের জন্য/এবং আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত/একটি আকাশের জন্য/তৃষিত আমরা নতুন একটি সূর্যের জন্য/কোন পূর্বাচলে ছুটে যাবো, কোথায় পাবো সূর্যোদয়, জুলকারনাইন?” (একটি সূর্যের জন্য)
“আমাদেরও জন্যে/একখানা প্রাচীর তৈরি করে দেবেন জুলকারনাইন?/তাদের এবং আমাদের মধ্যে/একখানা সীসাঢালা মজবুত প্রাচীর?/আমাদেরই লোক আজ হানাদার:/স্বজাতির সম্পদে চালায় লুন্ঠণ/লুটে সম্ভ্রম/আনে ত্রাস/আনে রক্তপাত-যেন ইয়াজুজ মাজুজ”। (জুলকারনাইনের চতুর্থ সফর)
পুঁজিবাদপীড়িত এই সময়ে এক শিশুর আর্তকন্ঠ-
“আজকেই আমি মাটিতে রেখেছি পা অথচ/সাতষট্টি হাজার দুশো তেত্রিশ টাকার ঋণের দায়/তুমি চাপিয়ে দিয়েছো কাঁধে।”
এবং কবির সর্বশেষ প্রার্থনা-
“ওগো আশ্চর্য কাহাফের প্রভু/গুহাবাসী হতে আমরাও উন্মুখ।”
“চাই কাহাফের ঘুম” একুশে বইমেলা-২০২১ এ প্রাকৃত প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ৬৪ পৃষ্ঠার কবিতাবইটির প্রচ্ছদ করেছেন লুৎফুর রহমান তোফায়েল। মূল্য ১৫০ টাকা।
বইটির পাঠকপ্রিয়তার সাথে সাথে সাহিত্যজগতে এই কবির স্থায়িত্ব কামনা করছি।