যুক্তরাষ্ট্রের সেই সমরাস্ত্রই এখন তালেবানের হাতে
আন্তর্জাতিক সময়
এক মাস আগে আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন সাতটি হেলিকপ্টারের ছবি দিয়েছিল সোশাল মিডিয়ায়। এগুলো এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এগুলো দেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছিলেন- আফগান বাহিনীকে এই ধরনের আরও সহায়তা দিয়ে যাওয়া হবে।
তার কয়েক সপ্তাহ পর গোটা আফগানিস্তান এখন তালেবানের করায়াত্ত। সেই সঙ্গে করায়ত্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সেই সমর সরঞ্জামও, আফগান সেনারা যেগুলো ফেলে পালিয়েছে।
যেসব অস্ত্র নিয়ে তালেবানের বিরুদ্ধে দুই দশক আগে অভিযান শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র; পটপরিবর্তনে তার অনেকগুলোই এখন এই দলটির হাতে। এসব সমর সরঞ্জামের মধ্যে ড্রোনও রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের যে ড্রোন হামলায় পাঁচ বছর আগে তালেবানের শীর্ষ নেতা আখতার মনসুর মারা গিয়েছিলেন।
এই সপ্তাহের শুরুতে কাবুল সরকারের পতন ঘটার পর এক ভিডিওতে দেখা গেল, সাঁজোয়া যানের বহরের সামনে তালেবান সদস্যরা, তারা পরীক্ষা করে দেখছে নতুন নতুন নানা সমরাস্ত্র, এমনকি ড্রোনও।
“ধ্বংস করা যায়নি, এমন যা কিছু আছে, তার সবই এখন তালেবানের হাতে,” বলেন যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা।
নিজেদের সেই যুদ্ধাস্ত্র নিয়েই এখন উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের। তাদের আশঙ্কা, তালেবান যেমন বেসামরিক মানুষের উপর এগুলো ব্যবহার করতে পারে, আবার এগুলো ইসলামিক স্টেটসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতেও চলে যেতে পারে। আর তা হলে নিজেদের অস্ত্রে নিজেদেরই ঘায়েল হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
এই অস্ত্র চীন কিংবা রাশিয়ায় পাচার হয়ে যেতে পারে, এমন শঙ্কাও করছেন ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা। সম্ভাব্য এমন সব বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।
হেলিকপ্টারের মতো বড় সমর সরঞ্জাম উড়িয়ে দিতে এখন বিমান হামলা চালানো যেতে পারে। কিন্তু তাতেও ভয়, যদি তালেবান ক্ষিপ্ত হয়। তাহলে কাবুল বিমানবন্দর দিয়ে মানুষকে সরিয়ে আনার কাজে বাধা আসতে পারে। এখন সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কাজ।
কী পরিমাণ সমর সরঞ্জাম তালেবানের হাতে পড়েছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন- এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজারের মতো সাঁজোয়া যান, যার মধ্যে হামভি যানও রয়েছে; রয়েছে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারসহ ৪০টি উড়োজাহাজ, স্ক্যানইগল মিলিটারি ড্রোন।
রাতের অন্ধকারের দেখার জন্য নাইট-ভিশন গগলসও তালেবানের হাতে পৌঁছেছে।
“আমরা এরই মধ্যে তালেবান যোদ্ধাদের আমেরিকান অস্ত্র হাতে দেখেছি, যা তারা ছিনিয়ে নিয়েছে আফগান বাহিনীর কাছ থেকে। এটা আমাদের এবং আমাদের মিত্রদের জন্য একটা বড় হুমকি,” বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য মাইকেল ম্যাককউল।
এগুলো এখন সাজানোর মতো?
এক হিসাবে দেখা যায়- ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনীকে ২৮০০ কোটি টাকার সমরাস্ত্র দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে বন্দুক, রকেট, নাইট-ভিশন গগলস, গোয়েন্দা নজরদারি চালানোর জন্য ড্রোন।
তবে উপহারের তালিকায় সবকিছুর উপরে ছিল ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার। তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগান সেনাদের এটা বেশ এগিয়ে রাখত। ২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আফগান বাহিনীকে ২০৮টি বিমান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র- এই তথ্য জানাচ্ছে ইউএস গভার্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিবিলিটি অফিস।
তবে এই সপ্তাহে তালেবানের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে এই বিমানগুলোকে আফগান পাইলটরা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেন- ৪০-৫০টি বিমান নিয়ে আফগান বৈমানিকরা পালিয়ে উজবেকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু বিমান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আগেই এসেছিল, সেগুলো এখন থেকে যাবে।
তালেবান হেলিকপ্টার-বিমান পেলেও তা চালাতে পারবে না বলেই আত্মপ্রবোধ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। দেশটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন- এই বিমানগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। আর বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়া এগুলো চালানোও কঠিন।
২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের নেতৃত্বদাতা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জোসেফ ভোটেল বলছেন- যে সমরাস্ত্রগুলো তালেবানের হাতে গেছে, সেগুলো স্পর্শকাতর প্রযুক্তি সম্বলিত নয়। “বেশিরভাগে ক্ষেত্রে বলা যায়, এগুলো এখন ট্রফি হিসেবে সাজিয়ে রাখার মতো,” বলেন তিনি।
চীনের হাতে যাওয়ার ভয়
অনেক অস্ত্র ‘ট্রফির’ মতো হলেও নাইট-ভিশন গগলসসহ সহজে ব্যবহারযোগ্য কিছু অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আফগান পদাতিক বাহিনীকে এম১৬ রাইফেলসহ কমপক্ষে ৬ লাখ অস্ত্র, ১ লাখ ৬২ হাজার যোগাযোগ সরঞ্জাম, ১৬ হাজার নাইট-ভিশন গগলস দিয়েছে। “অন্ধকারে যুদ্ধ করার সামর্থ্যই আসলে যুদ্ধের আসল অস্ত্র,” বলেন যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা।
জেনারেল ভোটেলসহ অন্য কর্মকর্তারা বলছেন- মেশিনগান, মর্টারের মতো যেসব অস্ত্র তালেবান পেয়েছে, সেগুলো তাদের পাঞ্জশিরের মতো এলাকায় লড়াইয়ে কাজে দেবে, যেখানে তালেবানবিরোধীরা শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আশা করছেন- অধিকাংশ অস্ত্র তালেবান নিজেরাই ব্যবহার করবে। তবে তাদের ভয় একটাই যে এটা না আবার চীনের মতো কারও হাতে চলে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্মান মার্শাল ফান্ডের চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এন্ড্রু স্মলের ধারণা- বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে আগ্রহী তালেবান এই অস্ত্র ভাণ্ডার চীনের হাতে দিতেও পারে।
তবে তাতে যে চীনের খুব লাভ হবে, তা মনে করছেন না যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলছেন- চীন এমন অস্ত্র আগেও দেখেছেন। সুতরাং এ থেকে তাদের নতুন কিছু পাওয়ার নেই।
সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চের কর্মকর্তা জাস্টিন ফ্লেইশনার বলছেন- মিত্রদের সমর সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আরও চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। “যদিও আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যা হয়ে গেছে, সেটা আর বদলানো যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।