তাবলীগ জামাতের উপর আরোপিত সৌদি সরকারের অভিযোগ ও আমাদের পর্যালোচনা
মুফতি আবুল কালাম আযাদ
সৌদি সরকার যে চিন্তাগত দিক থেকে ইসরাঈলের কাছে এবং ক্ষমতাগত দিক থেকে আমেরিকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে সেটা বিশ্ব পরিস্থিতি সামান্য বুঝেন এমন জনসাধারণের কাছেও পরিস্কার। কিন্তু আমরা এখন কনফিউশনে আছি সৌদি আরবের আলেমদের নিয়ে। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী শাষকের প্রভাব জনগণের উপর প্রতিফলিত হয় বলে আলেমরাও শ্রুতের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেবেন এমনটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
তাবলিগ জামাত নিয়ে সম্প্রতি সৌদি আরবের রাষ্ট্রিয় বক্তব্যটি তো আলেমরাই তৈরী করে দিয়েছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া শ্রুত কথার উপর বিধান প্রয়োগ করেন সৌদি আলেমরা, এমন পরিস্থিতির জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আরবদের ইলমের (শরীয়তের জ্ঞানের) উপর আমাদের অগাধ আস্তা ছিল, সেটাও তারা হারাতে বসেছে। বিশ্বব্যপী সফলতার সাথে খেদমতরত একটি জামাতের বিষয়ে এমন টুনকো অভিযোগ আরবরাও উঠাতে পারে কল্পনা করিনি।
কয়েক যুগ আগে থেকেই উলামায়ে দেওবন্দ সমাধান করে দিয়েছেন এমন কিছু অভিযোগ নতুন করে সৌদি সরকার উত্তাপন করায় তাদের চিন্তাগত পঁচনের বিষয়টি মুসলিম উম্মাহকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। মোটা দাঁগে তারা চারটি অভিযোগ এনেছে- যেগুলোর জবাব আমাদের দেশের সাধারণ তাবলিগী সাথীরাও জানে।
- ১. এটা বিদাআতি জামাত।
- ২. এটা সুফী মতাদর্শী জামাত।
- ৩. এটা থেকে সন্ত্রাসী বিস্তার করে।
- ৪. তিন দিন, ৪০ দিনের চিল্লা এবং তিন চিল্লা তথা চার মাসের সময় লাগানো আপনারা কোথায় পেলেন। অর্থাৎ, শরীয়ত সম্মত কি না?
প্রথম অভিযোগ দু’টি তো দিবালোকের ন্যায় হাস্যকর। তৃতীয় অভিযোগটি মারাত্বক। এটিকে অভিযোগ বলা যাবে না বরং এটি একটি অপবাদ বলতে হবে। যাদের হৃদয়গলা কথা দিয়ে সন্ত্রাসীদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার হাজারো নজির বিশ্বময় সুখ্যাত তাদের ব্যাপারে এমন ফালতু কিংবা কু-পরিকল্পিত অভিযোগকে অপবাদ না বলে উপায় নেই।
এমন অপবাদের কারণে মুসলিম উম্মাহর কলিজায় আঘাত লেগেছে। ওরা ক্ষমা পাওয়ার অধিকার হারিয়েছে। চতুর্থ অভিযোগ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এটা আলেমদের কাজ।
প্রশ্ন হয় সৌদি আরবের আলেদের শরীয়ত জ্ঞান নিয়ে। কোনটি শরীয়তের বিধান আর কোনটি শরীয়তের বিধানের উপর প্রেক্টিস সেটাই যারা পার্থক্য করতে পারে না, তারা কিভাবে যুগ যুগধরে চলে আসা বিশ্বব্যাপী কর্মরত একটি জামাতের উপর অভিযোগ করে আমার বুঝে আসে না।
একজন ছাত্র জ্ঞানার্জনের জন্য সপ্তাহিক কোর্স, মাসিক কোর্স, ত্রৈমাসিক কোর্স এবং বাৎসরিক কোর্স করার যদি কোনো দলিল খুঁজার প্রয়োজন হয় না, দ্বীন শিখার জন্য তিন দিন, চল্লিশদিন কিংবা চার মাসের দলিল খুঁজাও যে গাজাখুরি কথা সেটা কে কাকে বুঝাবে?
প্রথম দু’টি অভিযোগকে হাসির পাত্র বলে উড়িয়ে দিলাম এ জন্য যে, অভিযোগ দু’টি আকিদার সাথে সম্পৃক্ত। আর দেওবন্দি মতাদর্শের আকিদার ব্যাপারে তামাম দুনিয়ায় কোথাও কোনো অভিযোগ নেই।
বিশ্বের বড় বড় সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামী মারকাজগুলোতে তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দি মতাদর্শ নিয়ে যুগ-যুগধরে থিসিস হচ্ছে।
বড় বড় গবেষকরা তাবলীগে সময় লাগিয়ে মন্তব্য করছেন এবং মানুষকে তাবলীগের প্রতি উৎসাহিত করছেন। অথচ মুসলমানদের ধর্মীয় প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরবের আলেমরা সেই জামাত নিয়ে ইয়াহুদীদের মদদপুষ্ট সরকারের সুরে সুর মিলাচ্ছেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য এর থেকে বড় আফসোসের বিষয় আর কি হতে পারে।
মূল বিষয় অন্য জায়গায়। মুসলমানদের দেশ-জাতি এবং জাতীয়তাবাদে বিভক্ত করা গেলেও তাবলিগ জামাতের কারণে সেই মিশন পুরোপুরি সফল করা যাচ্ছে না। জেলায়-জেলায়, দেশে-মহাদেশে জোড়, এমনকি বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে আবার একতার বন্ধন তৈরী হয়ে যায়। তাই মুসলমানদের দ্বারাই তাদের বিভক্ত করা ষড়যন্ত্র হিসেবে ইতোপূর্বে তাবলীগে দু-গ্রুপ তৈরী করতে সক্ষম হলেও এর বৈধতার জন্য মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্রকে বেছে নিয়েছে।
বিল আখের মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় জামে আযহার তথা আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উলুমুল কুরআন ও তাফসীর বিভাগের অধ্যাপক ড. বকর ইসমাঈল হাফিযাহুল্লাহর তাবলীগের উপর করা একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেন- ‘আমি এই জামাতকে একান্ত নিকট থেকে দেখেছি বরং আমি তাদের সাথে সময় লাগিয়েছি। আমি তাদের মাঝে কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত কোন কাজ লক্ষ করিনি। এমনকি আমি তাদের মাঝে এমন কিছু পেয়েছি যা আমি প্রেকটিকালি অন্য কোথাও পাইনি। (দারুল হাদিস প্রকাশনী কায়রো, মিশর থেকে প্রকাশিত “হায়াতুস সাহাবা” কিতাবের ১ম খন্ডের ৯ নং পৃষ্ঠা থেকে ১৩ নং পৃষ্ঠাব্যাপী করা তাঁর মন্তব্যের চুম্বকাংশ উলামায়ে কেরামের জন্য নিম্নে উল্লেখ করছি।)
ولقـد عرفتهم عن قرب وخرجت معهم ، فما رأيت منهم ما يخالف كتابا ولا سنة ، بل لقد تعلمت منهم ما لم أكن أجده إلا عندهم .
فهم قوم يكثـرون من قـراءة القـرآن والذكـر الـمـشـروع ، ويقـيـمـون الصلاة في المساجد ، ولا تكاد تجد رجلا منهم يتخلف عن صلاة الجماعة ، لا يخوضون في أعراض الناس ولا يتكلمون إلا بخير ، ويبتعدون كل البعد عن الخوض في الخلافات المذهبية حتى تظل قلوبهم مؤتلفة على طاعة الله ورسوله ، فإن الخوض في الخلاف كثيراً ما يحدث العداوة والبغضاء بين المتحابين ، الأمر الذي يمزق وحدة المسلمين ويفرق جمعهم ويذهب ريحهـم ويشغلهم بأنفسهم عن نصرة دينهم وتأدية ما أوجبه الله عليهم ، وهم أغنياء بالله فقراء إليه ، لا يسألون الناس شيئا ولا يتخـذون على دعوتـهـم إلى الله أجرا ، ولا ينزلون ضيوفا على أحد ، بيوتهم المساجد ، ولا يعتمد بعضهم على بعض في النفقات ، بل كل واحد منهم ينفق على نفسه من ماله الخاص في السفر والحضر ، فلا تكاد تجد واحدا منهم يعيش – عالة على غيـره . ليس لهـم أمـيـر دائم ، فكلهـم أمراء ، إذا خرجوا في سبيل الله أمروا عليـهـم واحدا منهم ، بعضهم خدم لبعض ، لا يحب واحد منهم أ أن أن يتميز عليهم في شيء ، فترى أكبرهم سنا وأكثرهم علماً وأوفرهم مالا وأعلاهم منصبا يطهو الطعام ويعده لإخوانه في تواضع جم وسماحة نفس ، وسلامة طبع وحسن خلق.
وقد رأيتهم يحبون العلماء ويجلونهم الإجلال كله ، ومن آدابهم في توقير العلماء خفض الصوت في مجالسهم ، وحسن الإنصات إليهم والتفاني في خدمتهم ، والتغاضي عن هفواتهم وزلاتهم ، وطلب الدعاء منهم ، وما رأيت قوماً أطوع إلى العلماء العاملين منهم .
وهم قوم لا يتكلمون في السياسة ولا يحومون حولها ولا يتكلمون في المشكلات الاجتماعية إلا بقدر ما تقضى به الضرورة ، ومبلغ همهم طلب الآخرة مع الاحتفاظ بنصيبهم من الحياة الدنيا .
وهؤلاء الكرام البررة لا يأمرون الناس بالبـر وينسـون أهليـهـم وذوى رحـمـهـم ، بل يجعلون لهم النصيب الأكبر من أوقاتهم في تربيتهم على الفضائل وتنشئتهم على حب العمل الصالح ، ويعدونهم . إعدادا صحيحا لتحمل أعباء الدعوة إلى الله عز وجل والخروج في سبيله وابتغاء مرضاته ، فتراهم يصحبون معهم أبناءهم إلى المساجد لإقامة الصلاة والجلوس في حلقات العلم ، ومنهم من يرسل بعض أبنائه إلى الهند وباكستان ليتشرب هناك مع رجال التبليغ والدعوة أصول العمل ويتذوق حلاوته ويحفظ ما شاء الله أن يحفظ من كتب السنة ثم يعود راشدا إلى بلده داعيا ومعلما . ولعلك أيهـا الأخ الكريم تسألني عن الأصول الأربعين التي اعـتـمـدت عليـهـا جـمـاعـة التبليغ والدعوة في نشر الإسلام وهداية العصاة من المسلمين وإحياء سنة النبي ﷺ ، أين هي وكـيـف ما الله الحصول عليها ؟ . فإن سألت عنها فاسأل خبيراً بها ، وإنك لو التقيت بهم ، وأسعدك الحظ المقدر لك أن تجلس معهم ، وأن تتقرب إلى المتعلمين منهم والقدامي من رجالهم فإنك ستتعرف على هذه الأصول من خلال أفعالهم وأقوالهم وحركاتهم وسكناتهم من غير عناء في البحث عنها هنا وهناك ، وسوف أفردها في كتاب خاص إن شاء الله تعالى ، وإنى لا أحرمك هنا من ذكر أهمها إجمالا فأقول : قد نظر أولئك الأعلام الذين أسسوا هذه الجماعة المجاهدة في سيرة النبي ﷺ وسيرة أصحابه الكرام البررة رضوان الله عليهم ، واستطاعوا بعد التأمل العميق في عباداتهم ومعاملاتهم وعاداتهم فوجدوا أنها لا تخرج عن الأوصاف الاتية:
লেখক; মুফতি আবুল কালাম আযাদ
গ্রন্থকার, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস জামিয়া ইসলামিয়া বুধবারীবাজার, গোলাপগঞ্জ, সিলেট।