কাতার বিশ্বকাপ যখন ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলনের সুযোগ
ইশান থারুর
স্পেনের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর জয়ের পর বিজয়ী মরক্কো দল একটি পতাকা নিয়ে ছবি তুলেছে। সেটি তাদের নিজেদের লাল জমিনের ওপর সবুজ তারকাখচিত পতাকা ছিল না; এটি আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া বা লেবাননের পতাকাও ছিল না। এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে নিখিল-আরব সংহতির প্রতিফলন ঘটানো ফিলিস্তিনি পতাকা।
মরক্কোর দর্শকেরা নিজেদের পতাকার বদলে ফিলিস্তিনের পতাকা নেড়ে এমন একটি বিষয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন, যা অন্য আরবদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি তুলে পুরো টুর্নামেন্টকে চমকে দিয়েছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আয়োজিত ওই ম্যাচে দর্শক গ্যালারিজুড়ে ফিলিস্তিনি প্রতীকগুলো ছিল। দর্শকদের কাঁধজুড়ে, স্কার্ফে, টি-শার্টে সবখানে প্রতীকগুলো শোভা পাচ্ছিল।
মরক্কোর রাজধানী রাবাতের বাসিন্দা মোনা আলাউবি খেলা শুরুর আগে স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর গায়ে ছিল মরক্কোর জাতীয় দলের টি-শার্ট। টি–শার্টের ওপরে ছিল একটি ফিলিস্তিনি কাফিয়াহ (সাদা জমিনের ওপর কালো রঙের খোপ খোপ ছাপের স্কার্ফের মতো কাপড়বিশেষ। ফিলিস্তিনিরা তাঁদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে এটি পরে থাকেন)। আমি মোনা আলাউবির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি বললেন— ‘রাজনীতি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর দেশের নেতাদের ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত রাজনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে সই করার বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন— ‘আমি ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করি কারণ আমি একজন মানুষ এবং তারা আমাদের ভাইবোন।’
এখন দেখা যাচ্ছে— কাতারের স্টেডিয়ামে ফুটবলের পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্বেগের বিষয়, বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যু চারদিক থেকে নেমে আসছে। কাতারের কর্তৃপক্ষ সমকামীদের রংধনু এবং ইরান সরকারের বিরোধী আইকনোগ্রাফিগুলোকে নিষিদ্ধ করলেও ফিলিস্তিনি পতাকা বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামগুলোতে হরহামেশা দেখা যাচ্ছে, মাঠে যে দলই খেলুক না কেন।
স্পেনের বিরুদ্ধে মরক্কোর জয়ের মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন আলাদ্দিন আয়াদ নামের একজন ফিলিস্তিনি। দোহায় একজন সাইবার নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করা ৪২ বছর বয়সী আয়াদ আমাকে বলছিলেন— ‘আমার খুব ভালো লাগছে যে এই আরব জাতীয়তা আমাদের সমর্থন দিচ্ছে এবং এটি পশ্চিমাদের দেখাচ্ছে যে ফিলিস্তিনিরা শেষ হয়ে যাবে না।’ তিনি বলছিলেন— বিশ্বকাপ স্পষ্টতই তাঁদের সামনে তাঁদের মুক্তির দাবি তুলে ধরার সুযোগ এনে দিয়েছে।
তিউনিসিয়ার একটি ম্যাচ চলাকালে দর্শক সারি থেকে একজন হঠাৎ ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মাঠে ঢুকে পড়েন এবং এ ঘটনার পরই মূলত স্টেডিয়ামগুলোতে ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’ লেখা ব্যানার মেলে ধরে দর্শকদের স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে। খেলা চলাকালে আরব দেশগুলোর ফুটবল ভক্তদের ফিলিস্তিনিদের অধিকারের জন্য এবং ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ফিলিস্তিনিদের সাম্প্রতিক হত্যার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে।
কাতার ও ইসরায়েলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও ইসরায়েলি সাংবাদিকদের বিশ্বকাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এখন ইসরায়েলি সাংবাদিকদের দোহায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে ইসরায়েলি সাংবাদিকদের পথচারীদের তিরস্কার করতে দেখা গেছে। ইসরায়েলের ইয়েদিওত আহারোনোত পত্রিকার সাংবাদিক রাজ শেচনিকের সামনে এসে এক মরোক্কান ফুটবলপ্রেমী ‘ফিলিস্তিন!’ বলে চিৎকার করে তাঁকে উত্ত্যক্ত করলে তিনি ওই মরোক্কান নাগরিককে বলেছেন— ‘আপনি কিন্তু শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন!’
ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগে আব্রাহাম চুক্তি নামের ওই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল এবং চারটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ প্রশস্ত করেছে। দেশগুলো হলো— সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান। এর মধ্যে প্রথম তিনটি দেশেই রাজতন্ত্র জারি আছে।
স্পেনের বিরুদ্ধে মরক্কোর জয়ের মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন আলাদ্দিন আয়াদ নামের একজন ফিলিস্তিনি। দোহায় একজন সাইবার নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করা ৪২ বছর বয়সী আয়াদ আমাকে বলছিলেন— ‘আমার খুব ভালো লাগছে যে এই আরব জাতীয়তা আমাদের সমর্থন দিচ্ছে এবং এটি পশ্চিমাদের দেখাচ্ছে যে ফিলিস্তিনিরা শেষ হয়ে যাবে না।’ তিনি বলছিলেন— বিশ্বকাপ স্পষ্টতই তাঁদের সামনে তাঁদের মুক্তির দাবি তুলে ধরার সুযোগ এনে দিয়েছে।
লেখক : ইশান থারুর, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর বিদেশি ডেস্কের একজন কলামিস্ট। [কলামটি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত]
বি.দ্র. মুক্তকথন বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে দৈনিক সময়সিলেট—এর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। দৈনিক সময়সিলেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তকথনে প্রকাশিত লেখার দায় দৈনিক সময়সিলেট—এর নয়।