জেল হত্যা দিবস : বড় বেদনার বড় লজ্জার
সময় সিলেট ডট কম
মো. সেলিম আহমেদ:
বাঙালির ইতিহাসে বহু গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে। তেমনি এক অধ্যায় ১৯৭১। সেটি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে অনন্য এক অধ্যায়। ওই বছরে বাঙালি অর্জন করেছে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ স্বাধীনতা। আবার কিছু কিছু দিন আছে, যেগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো দিন হিসেবে পরিগণিত। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বর তেমনি নৃশংসতম দিন। ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় সপরিবারে। ৩রা নভেম্বর নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।
আজ ৩রা নভেম্বর, জেল হত্যা দিবস, বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বর্বরোচিতভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার কিছুদিন পরই বঙ্গবন্ধুর আজীবন রাজনৈতিক সহচর, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন- ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা এ দেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র জাতির পিতাকে হত্যা করে। এরপর খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে স্বাধীনতা বিরোধী ওই চক্র এ দেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। বাংলাদেশ যাতে এগিয়ে যেতে না পারে, স্বাধীনতা যাতে ব্যর্থ হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় সেই চক্রান্ত করে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র।
এদেশে যেন কোনদিন স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই ষড়যন্ত্র থেকেই নিরাপদ স্থান জেলখানার অভ্যন্তরে এই হত্যাকাণ্ড তারা সংঘঠিত করে। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থেকে জাতীয় চার নেতা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় তাঁর অবর্তমানে এই চার নেতা মুজিবনগর সরকার গঠন, রণ নীতি ও রণ কৌশল প্রণয়ন, প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, কূটনৈতিক তৎপরতা, শরণার্থীদের তদারকিসহ মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করতে অসামান্য অবদান রাখেন। জাতি তাদের অবদান চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে যখন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে এই চার নেতা আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন। ঘাতক চক্রের লক্ষ্য ছিলো বাঙালিকে নেতৃত্ব শূন্য করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের পদানত করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে আটক করে রাখার পর যে চার নেতা বঙ্গবন্ধুর হয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন সেই চার নেতাকেও বঙ্গবন্ধুর মতো নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চরম নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হচ্ছে জেলহত্যা দিবস। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব নগর সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে এদেশের জনগণকে একত্রিত করে দেশের বিজয়ের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছেন সেই চার নেতাকে চরম নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তবে মৃত্যুর আগে এই চার নেতা রেখে গেছেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। যা সমর্পিত ছিল দেশ ও মানুষের কল্যাণে। ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু এরপর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র বিনির্মাণে ছিলেন তারা অগ্রপথিক। আর সেটাই কাল হলো তাদের জন্য। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ঘাতকদের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন চার নেতা। আর তাই তাদের হত্যা করে নিশ্চিত থাকতে চাইলো ষড়যন্ত্রকারীরা। আসলে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট এবং তেসরা নভেম্বর একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিয়ে তারা মনে করেছিলো বাংলাদেশকে পাকিস্তানী দেশে নিতে পারবে কিন্তু তারা নিশ্চিত হতে পারেনি, তাই এই তেসরা নভেম্বরের জেলহত্যা। জেল হত্যার মতো জঘন্য হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে খুব কমই হয়েছে।
এমনই দুর্ভাগা দেশ, যেখানে জেলখানার মতো জায়গায় নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়। এমন ঘটনা যেন আর ঘটতে না পারে, তার জন্য এখন থেকে অামাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া যারা রাতের অন্ধকারে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচিত জেলখানায় এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিলো, তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক। বাঙালি জাতি কোনো কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে চায় না। জাতি কলঙ্কমুক্ত হতে চায়। পরিশেষে জাতীয় চার নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
লেখক: চেয়ারম্যান- এসএমএস মিডিয়া লিমিটেড, সিলেট।