প্রাণের ডিসেম্বর : আবার বিজয় লগণ এসেছে
সাইফুল ইসলাম রানা :
সাইফুল ইসলাম রানা : বারো মাসে ছয় ঋতু আর তেরো পার্বণের বাংলাদেশে ডিসেম্বর বরাবরই আলাদা। বিজয়ের মাস বলে কথা। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে নভেম্বর ডিসেম্বরে হওয়া মানেই বিজয়ের আরেকটি উদযাপন। বলাই বাহুল্য ডিসেম্বর তাই আমাদের কাছে অন্য গুরুত্ব বহন করে। হাজার বছর ধরে স্বাধীনতাহীন বাঙালী জাতি বিজয়ের মাধ্যমে সার্বভৌম দেশ অর্জন করেছে এ মাসেই। আর এ অর্জনে দিতে হয়েছে এক সাগর রক্ত আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম। যতোদিন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে, ততোদিন ডিসেম্বর বিজয়ের মাস হিসেবে উদযাপিত হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, ঘাতক দালাল রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা যুগ যুগ ধরে ভীষণ ভয়ে থাকবে, বাঙালীর তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার থেকে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করবে এ মাসে।
বাঙালীর অহংকার বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালী তার আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকা পেয়েছিল যে মাসে, তার নাম ডিসেম্বর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজারো বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূখণ্ডের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণকে পদানত করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানরা ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাথা বিজয় অর্জনের মাস।
একাত্তরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যতোই এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন ততোই এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিংস্র পাকহানাদার বাহিনীরা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজি তার রাজাকার, আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারদিকে ছড়িয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাতে। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন।
একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনগুলোকে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালীর বিজয়রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দখলদার পাক হানাদারদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানিরা সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধও শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের দোসর হয়ে ওঠে। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অকৃপণ সহযোগিতায় সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। আর দিনে দিনে বাঙালীর কাছে মুক্তিযুদ্ধ এক ভিন্ন মাত্রা পেতে শুরু করে। বর্ষা, শরৎ আর হেমন্ত পেরিয়ে শুরু হয় শীতের মৌসুম। গ্রামবাংলা জুড়ে শীত নামে। কিন্তু শীত নেই মুক্তিপাগল বাঙালীর। হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে দেহের রক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটছে। একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে চারদিকে বীর বাঙালির বিজয়, আর পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর। দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যুদস্ত হতে থাকে হানাদাররা। ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিনই শত্রুর পরাজয়ের ক্ষণ গণনা চলছিল। এক একটি দিনে রচিত হচ্ছিল বাঙালীর বীরত্বগাথার নিত্যনতুন ইতিহাস। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের সেসব বীরত্বগাথা ইতিহাস আমাদের নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়।
তাই ডিসেম্বর বাঙালীর জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় মাস। এ মাসেই বাঙালী পেয়েছিল তার বহু কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের দেখা। পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা, পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়ে ৯ মাসের ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে এ মাসেই রচিত হয়েছিল এক অমর গাঁথা বাঙালীর মহান বিজয়। একটি মানচিত্র, একটি পতাকা, একটি দেশ। যার নাম বাংলাদেশ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু করেছিল, আজ তা বিশ্বের কাছে এক অপার বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেল।
হ্যাঁ, বছর ঘুরে আবার এসেছে ডিসেম্বর, প্রাণের ডিসেম্বর, আবার বিজয় লগণ এসেছে। তাইতো ডিসেম্বরের প্রথমদিন থেকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পুরো মাসব্যাপী বিজয় উৎসব কর্মসূচী পালন শুরু হয়েছে। সত্যিই এক অন্যরকম পরিবেশে এই মাস পালন করছে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত গোটা বাঙালী জাতি। আনন্দ, আহ্লাদ আর বিনম্র শ্রদ্ধা নিয়েই বাঙালী জাতি স্মরণ করছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ শহীদানের জান, দু’লক্ষ মা-বোনের মান আর তখনকার সাত কোটি বাঙালীর এই আশ্চর্য কোরবানকে।
লেখক : পাবলিসিটি এন্ড পাবলিকেশন্স ডিরেক্টর- এসএমএস মিডিয়া লিমিটেড, সিলেট।