বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যই আজকের বাংলাদেশ বনাম ভাস্কর্য বিতর্ক
সালমান ফরিদ
একটি প্রশ্ন ভাস্কর্য বিরোধিতার মাধ্যমে জোর করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রশ্নটি হলো— ‘ভাস্কর্য শিরিক’— এটি কি শুধুই বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বিশেষায়িত?
আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। কেননা দেশে আরও হাজার ভাস্কর্য আছে। সেগুলো নিয়ে কোনো কথা নেই। হচ্ছে না। ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলতেও বলছে না বা বলেনি কেউ! শুধু বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বেলায়। কেন? এতদিন কথা বলিনি কেন? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তো এতো নাক ছিটকানোর কথা নয়। আমি আওয়ামীলীগ করি বা না করি, দলটিকে পছন্দ করি বা না করি, রাজনীতি করি বা না করি— কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারের উপায় নেই। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে দেশের চেয়ে নিজেদের সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করুক বা বানানোর চেষ্টা করুক অথবা বানিয়েও ফেলুক, একথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর একটি শারীরিক অবয়ব হয়তো ছিল, কিন্তু জাতিসত্বার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যই হলো আজকের বাংলাদেশ। অস্বীকারের উপায় আছে? বঙ্গবন্ধুকে সার্বজনীন করা থেকে আমাদের দূরে থাকাটা হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় ব্যর্থতার একটি। এই ব্যর্থতার পুরো দায় আওয়ামী লীগের। এই দায় তারা এড়াতে পারে না। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী, জিয়াউর রহমান, জাতীয় চারনেতা— এরা কোনো বিশেষ দলের হতে পারে না। এরা দেশের। এরাই বাংলাদেশ। কিন্তু এটি না হবার জন্য দায়ী আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো।
এবার মূল কথায় ফেরা যাক। আমরা জানি, ইসলাম ধর্মে মূর্তি এবং ভাস্কর্য স্থাপনে বৈধতা নেই। একজন মুসলিম হিসেবে যা ইসলামে নেই, সেটি আছে বা সেটিকে মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সেটিকে বৈধতা দেয়ার তাই প্রশ্ন আসে না। অনেকের মত আমার বেলায়ও। কিন্তু আরেক ধর্মের অনুসারীরা যদি তাদের ধর্ম পালনের জন্য মূর্তি বানায়, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে সেটিকে গুড়িয়ে ফেলার কোনো সুযোগ আছে? নেই। তাই যদি হতো তাহলে আরও যেসব দেশ, যেমন— ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা বাকি দেশগুলোতে আমাদের উপাসনালয় থাকার কথা না অধিকারও রাখে না। এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগও কারো থাকে না। থাকে কি?
ভাস্কর্য মূর্তি নয়, তাই ‘উপাসনার জন্য নির্মিত হচ্ছে’— এটি বলারও সুযোগ নেই। কারণ আপনার মানি ব্যাগে থাকা ছবিটিও এক অর্থে ভাস্কর্য। কিংবা যে কোনো প্রাণির প্রতিচ্ছবি। সোকেসে থাকা খেলার পুতুল। দোকানের ডল। দেশের প্রায় প্রত্যেকের ঘরেই নিজের অথবা স্বজনের অথবা প্রাণির ছবি আছে, কোন না কোনোভাবে। টাকায়ও আছে! সে হিসেবে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকের ঘরে ভাস্কর্য আছে। প্রত্যেকের সাথে আছে। কই, আমরা কখনও সেটি ছুঁড়ে ফেলেছি? অস্বীকার করেছি? যদি ভাস্কর্য শিরিকই হলো, তাহলে নিজেদের ঘরে শিরিক কেন? আর যদি শিরিক না হয়, হারাম হয়, তাহলে নিজের ঘরে হারাম কেন? মানি ব্যাগে হারাম কেন?
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ, কিন্তু ‘ধর্মীয় দেশ’ নয়! দেশ চলে একটি সংবিধানের মাধ্যমে। এখানে ভাস্কর্য নির্মাণ আইনে অবৈধ নয়। সুতরাং ‘ধর্মীয়’ ইস্যুতে এর বিপরীতে স্রোত তৈরি আইনগত অন্যায়। তাই মূর্তি বলে ভাস্কর্য ভাঙার সুযোগ নেই। আর মূর্তি হলো অন্যের ধর্মীয় প্রতিমা। আপনার দেশে ভাঙলে আরেকজনের ধর্মীয় অধিকার হরণ করা হবে। যা অন্য দেশে আপনি বরদাশত করবেন না!
কথা হলো, যে কাজ আপনি বরদাশত করবেন না, সেটি কেন আপনি নিজে করবেন? করবেন কি এজন্য যে, তারাও আপনার ধর্মকে গালি দিক? এটি তো মহানবী স. আমাদের করতে বলেননি। বিদায় হজের ভাষণের কথা মনে আছে? মুসলমান হয়ে আমাদের প্রিয় নবীজী, রাসুলের স. বিদায় হজের ভাষণকে মনে রাখা সবার আগে দরকার। কিন্তু নেই। নেই বলে আজ পশ্চিমে ইসলাম চলে গেছে, সেখানে যদিও মুসলিম নেই। কিন্তু পূর্বে মুসলিম আছে অথচ আমাদের মধ্যে ইসলাম অনুপস্থিত! আছে শুধু দুর্দশা! যে দুর্দশার একটি উপসর্গ আজকে বাংলাদেশে ভাস্কর্য বিতর্ক। এই বিতর্ক আরোপিত। রাজনৈতিকভাবে আরোপিত। ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে সরকারের ‘বিরোধিতা’র একটি দামামা! এর মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চলছে বিপরীত বলয় থেকে। অতীতে তারা প্রকাশ্যে এলেও এবার সতর্ক! ধর্মীয় দল-উপদল বিষয়টি ধরতে পারছে, তবে সবাই ‘ধর্মীয় স্পর্শকাতরতায়’ এবং ‘পাছে লোকে কিছু বলবে’— এই জন্য ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে তারা কথা বলছে। বলতে বাধ্য হচ্ছে। আর এটি টনিকের মতো কাজও করছে। সরকার বিরোধি একটি মুভমেন্ট তৈরি হচ্ছে তৃণমূলে। এই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে একটি জাগরণ তৈরি করা হচ্ছে। যেটি কাজে লাগছে কোনো বড় ধরণের আন্দোলন ছাড়াই। অনেকটা বিনা যুদ্ধে রাজ্য লাভের মত। অর্থাৎ, ভাস্কর্য নিয়ে এই বিতর্ক প্রকৃত অর্থে একটি রাজনৈতিক দাবার খেলা। এখানে ‘ধর্মীয় ভালবাসা’ সাধারণ মানুষের মাঝে থাকলেও দাবার খেলোয়াড়দের নেই। আর এটি বুঝলেও সেখানে সরকার অনেকটা অসহায়! একথা মানতে হবে। এবং এটা দেখারও অপেক্ষা করতে হবে, এ থেকে সরকার কোন কৌশলে বেরিয়ে আসে।
মোদ্দা কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে ভাস্কর্য বৈধ নয়। মূর্তি তো শিরিকই। ধর্মের দৃষ্টিতে মুসলমানের এগুলো মানার সুযোগ নেই। আবার যখন বাংলাদেশ ‘ধর্মরাষ্ট্র’ নয়, তখন সেও ভাস্কর্য বিরোধি হতে পারে না। অন্যের ধর্মীয় উপাসনায় বাঁধাও মানতে পারে না। ইসলামী আইনে চললে সেই আইনেও বাঁধা দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যদি সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়? শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধিতা হয়? তাহলে?
লেখক : বিশিষ্ট কবি, কলামনিস্ট ও সাংবাদিক।
[বি.দ্র. : মুক্ত কথন বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে ‘দৈনিক সময় সিলেট’ এর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। ‘দৈনিক সময় সিলেট’ সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তকথনে প্রকাশিত লেখার দায় ‘দৈনিক সময় সিলেট’ নয়।]