আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির সেই সকালটি
ইকতিয়ার চৌধুরী
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনের কূটনৈতিক অভিযাত্রায় আমাদের নেতা ছিলেন ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। আমি ছিলাম তার ডেপুটি—উপস্থায়ী প্রতিনিধি। এ লড়াইয়ে দূতাবাস হতে আরেক সঙ্গী ছিল প্রথম সচিব মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি)। আর আমাদের সামনে ছিল বাধা পাহাড়সমান।
প্যারিস, ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯। এটি শুধু একটি ডেটলাইন নয়। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বিশেষ একটি দিন। ওই দিন একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পৃথিবীজুড়ে প্রতি বছর উদযাপিত হওয়ার স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ১৭ নভেম্বর সকালে তার প্লেনারি সেশনে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সর্বসম্মত এ বিরল স্বীকৃতি প্রদান করে, যা ছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন। এই অর্জন সহজ ছিল না। প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের যারা এ স্পর্শকাতর কূটনৈতিক লড়াইয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিল তারা তার সবটা দেখেছিলাম। পেশাদার কূটনীতিবিদ ছাড়াও এ লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর সচিব প্রফেসর কফিলউদ্দিন আহমেদ এবং ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ফেডেরিকো মেয়রের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ড. তোজাম্মেল টনি হক। ড. হক ইউকে প্রবাসী বাংলাদেশী এবং নব্বই দশকের শুরুতে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্পর্কিত প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেছিলেন ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯। ১০ সেপ্টেম্বর ছিল ইউনেস্কোতে তা উত্থাপনের শেষ দিন। উত্থাপনের শেষ দিন বিকালে ঢাকা থেকে ফ্যাক্সে পাঠানো প্রস্তাব দূতাবাসে এল। অস্পষ্ট। প্রফেসর কফিলউদ্দিনকে ফোনে সমস্যা জানালে বললেন তাদের ফ্যাক্স মেশিন ঠিকমতো কাজ করছে না। অতএব আমি প্রাপ্ত প্রস্তাব/রেজল্যুশনের ধীরে ধীরে পাঠোদ্ধার করতে থাকি আর আমার সহকারী তা টাইপ করে চলেন। অফিস সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট আনা মারিয়া মাজলফকে অনুরোধ করে তার দপ্তরে বসিয়ে রেখেছিলাম, যাতে বাংলাদেশের রেজল্যুশনটি শেষ দিনে তারা গ্রহণ করতে পারেন।
আমার তখন জানা ছিল না একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার উদ্যোগ কানাডাপ্রবাসী রফিকুল ইসলামদের সংগঠন মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ডের। এজন্য তারা জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বরাবর একটি আবেদনও করেছিলেন। সদস্য রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কেউ যেহেতু জাতিসংঘে এ ধরনের আবেদন করতে পারে না তাই তাদের বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনের মাধ্যমে তা করার পরামর্শ দেয়া হয়। আমি তখন এও জানব না একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর ‘গফরগাঁও থিয়েটার’ নামক একটি নাট্যদল দাবি করবে রফিকুল ইসলাম নয়, ১৯৯৭ সালে তারাই প্রথম ঘোষণা করেছিল একমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারিই হতে পারে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালনের উপযুক্ত দিন। ১৯৯৯ সালে একুশের সংকলনেও তারা পুনর্ব্যক্ত করেছিল তাদের দাবি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনের কূটনৈতিক অভিযাত্রায় আমাদের নেতা ছিলেন ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। আমি ছিলাম তার ডেপুটি—উপস্থায়ী প্রতিনিধি। এ লড়াইয়ে দূতাবাস হতে আরেক সঙ্গী ছিল প্রথম সচিব মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি)। আর আমাদের সামনে ছিল বাধা পাহাড়সমান।
১২ নভেম্বর কমিশন-২-এর অধিবেশনে রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রস্তাব এক লিখিত বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রদূত তার বিবৃতিতে বলেন, ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ইউনেস্কোর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভাষা একটি অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রচলন কেবল ভাষাতত্ত্বের বহুমুখিতা ও বহুমুখী শিক্ষাই উৎসাহিত করবে না, বিষয়টি সারা বিশ্বের সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
যেসব দিবস বা অনুষ্ঠান উদযাপনে আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে তাতে ইউনেস্কো বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। অন্যান্য দাতা দেশ যারা তাদের তহবিলে অর্থ জোগায় বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো অতি প্রয়োজনীয় খাত ছাড়া অর্থ ঢালতে রাজি ছিল না। আরেকটি বাধা ছিল নতুন একটি আন্তর্জাতিক দিবস পেতে ইউনেস্কোর অনাগ্রহ। পর্বত দিবস, টেলিভিশন দিবস ইত্যাদিসহ দুই শতাধিক এ রকম দিবসে আরো একটি দিন যুক্ত হোক এবং তা বিশ্বব্যাপী উদযাপনে ইউনেস্কোর প্রতি বছর লক্ষাধিক ডলার খরচ হোক, সে বিষয়ে সম্মতি অর্জন সহজ ছিল না। প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইউনেস্কো সচিবালয়ের সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠক হলো। নানাভাবে তাদের আমরা রেজল্যুশনের খসড়া করে দেখালাম, যাতে বিতর্ক পাশ কাটিয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় সম্ভব হয়। এদিকে সাধারণ অধিবেশনের সময়ও এগিয়ে আসছিল। তার আগেই এ সমস্যা সুরাহার প্রয়োজন ছিল, তা না হলে আমাদের প্রস্তাব ইউনেস্কো সচিবালয়ের মাধ্যমে খসড়া আকারে অধিবেশনে আলোচনা বা সম্মতির জন্য উঠবে না।
আমাদের কূটনৈতিক তত্পরতায় সমস্যাভেদী সাহায্য করলেন ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেল প্রফেসর ফেডেরিকো মেয়রের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ড. টনি হক। তার মাধ্যমে ডিজিকে রাষ্ট্রদূত বোঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রথমত তিনি বাংলাদেশের প্রস্তাবে অনুমোদন দিন। দ্বিতীয়ত, অধিবেশনে সদস্য দেশগুলো তাতে সম্মতি দিলে মাতৃভাষা দিবস পালনে যে আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে তা সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ তহবিল থেকে নির্বাহ করবে। ফলে ইউনেস্কোর কোনো বাজেটের দরকার পড়বে না। স্পেনের নাগরিক ও দেশটির একসময়ের মন্ত্রী ডিজি ফেডেরিকোর কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশিত সমর্থন পেয়েছিলাম। তাতে করে ড্রাফট রেজল্যুশন প্রকাশের শেষ দিন ২৬ অক্টোবর ১৯৯৯ বাংলাদেশের প্রস্তাব ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্রের বিবেচনার জন্য প্রকাশিত হলো।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কিত প্রস্তাবটি ছিল ইউনেস্কো কমিশন-২-এর অধিক্ষেত্রাধীন। এ ধাপে আমাদের তাই প্রয়োজন পড়ল রেজল্যুশনটির বিষয়ে তাদের সুপারিশ, যাতে সাধারণ কমিশন তা অনুমোদন করে। সমর্থন পেতে কমিশনের চেয়ারপারসন স্লোভাকিয়ার মোলনারের সঙ্গে মোয়াজ্জেম আলী স্যার আমাকে সঙ্গে করে অনেকগুলো বৈঠক করলেন। মোলনার বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তার দেশ অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মতো একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করেছিল। অনেকগুলো বৈঠকের দরকার হয়েছিল, কারণ কমিশনের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলোসহ অন্য দাতা দেশগুলোর সম্মতি আদায় কঠিন ছিল। এছাড়া প্রস্তাবটির প্রতি ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া ও স্পেনও রক্ষণশীল মনোভাব দেখায়। কমিশনের বৈঠকে আরো একটি কারণে আমরা বাধার সম্মুখীন হই। তা হলো পৃথিবীর বহু ভাষাভাষী বিভিন্ন দেশে ভাষা নিয়ে স্পর্শকাতরতা। এই দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া, ভারত, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, শ্রীলংকা ও মালয়েশিয়া উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থা দ্বারা একুশে ফেব্রুয়ারিভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক দিবসের স্বীকৃতি ওই সব দেশে স্বাধিকার কিংবা বিচ্ছিন্নতা উসকে দিতে পারে, এ আশঙ্কাও তাদের ছিল। তবে আনন্দের বিষয় বহু ভাষাভাষী দেশগুলোর অনেকেই শেষ পর্যন্ত আমাদের সমর্থন করেছিল। বৈঠকের পাশাপাশি আমরা অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় শুরু করেছিলাম। প্রথম আনুষ্ঠানিক সমর্থন দানকারী দেশ সৌদি আরব। শুধু সমর্থন নয়, তারা বাংলাদেশের প্রস্তাবের কো-স্পন্সর। মোট ২৮টি দেশ আমাদের রেজল্যুশনকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানায়। আসলে ২৮টি নয়, ২৯টি। ২৯তম দেশটি সুরিনাম। অজ্ঞাত কারণে সুরিনামের নামটি ইউনেস্কোর দলিলভুক্ত হয়নি।
সমর্থক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাকিস্তানকে পাওয়া ছিল অবিশ্বাস্য। এর আপাতকারণ ছিল ইউনেস্কোতে পাকিস্তানের ডেপুটি পার্মানেন্ট ডেলিগেট মাদাম রিফাতের সঙ্গে সখ্য। তবে তখন আমরা জানতাম না ১৭ নভেম্বর সাধারণ অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার পরদিন পাকিস্তান তার ভুল বুঝতে পেরে ওই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। অধিবেশনে মাতৃভাষা দিবসের ওপর সম্ভাব্য ভোটাভুটির মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রায় সত্তরটি সদস্য দেশ নিয়ে আমরা কয়েকদিনের কঠিন পরিশ্রমে একটি ‘ভোট ব্যাংক’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থার নির্বাচনে পারস্পরিক সমর্থনের ভিত্তিতে আমরা এ ভোট ব্যাংক তৈরি করি।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সর্বসম্মত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি প্লেনারিতে দেয়া হলো। সারা হলরুমে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম। কোনো দেশই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবে বিরোধিতা করল না। আমাদের যুগপৎ আনন্দিত ও শিহরিত করে তা পাস হয়ে গেল। উত্তেজনায় ড. সা’দত, মান্যবর রাষ্ট্রদূত, ড. হক, প্রফেসর কফিলউদ্দিন ও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। উষ্ণ করমর্দন চলল আমাদের মাঝে। দুই মাস ধরে আনুষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক যে কূটনৈতিক লড়াই চলছিল, যার বিস্তৃতি ঘটেছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ছাড়াও ইউনেস্কো ভবনের করিডর থেকে শুরু করে ক্যাফে, সেমিনার ও প্রদর্শনী কক্ষ, ডকস পিজন হোলস এমনকি স্যুভেনির শপ পর্যন্ত, তার কাঙ্ক্ষিত সমাপ্তিতে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।
১২ নভেম্বর কমিশন-২-এর অধিবেশনে রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রস্তাব এক লিখিত বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রদূত তার বিবৃতিতে বলেন, ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ইউনেস্কোর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভাষা একটি অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রচলন কেবল ভাষাতত্ত্বের বহুমুখিতা ও বহুমুখী শিক্ষাই উৎসাহিত করবে না, বিষয়টি সারা বিশ্বের সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তিনি উদ্বেগের সঙ্গে আরো উল্লেখ করেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু ভাষা বিলুপ্তির পথে, যা আশু রোধ করা প্রয়োজন। বিবৃতিটির সময় ঢাকা থেকে আসা প্রতিনিধি দলের বিকল্প নেতা ড. সা’দত হুসাইন, প্রফেসর কফিলউদ্দিন, ড. তোজাম্মেল টনি হক ও আমি উপস্থিত ছিলাম। ওই দিনই কমিশন আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। চূড়ান্ত অনুমোদন দিল ১৬ নভেম্বর। চূড়ান্ত অনুমোদনের আগের কয়েকটি মাত্র দিনে সমর্থনদানকারী ২৮টি দেশের সঙ্গে তাদের প্রতিশ্রুতি মজবুতের লক্ষ্যে ঝটিকা গতির পৃথক বৈঠক কীভাবে সম্ভব হয়েছিল তার জবাব আজও নেই। কমিশন-২-এর পর বাকি থাকল আরেকটি ধাপ। শেষ ধাপ ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত প্রদানকারী সর্বোচ্চ অঙ্গ সাধারণ অধিবেশনের প্লেনারি সেশনে প্রস্তাবটির সর্বসম্মত অনুমোদন।
মাত্র ২৪ ঘণ্টা পরেই ছিল ওই প্লেনারি সেশন। ২৪ ঘণ্টাও নয়। একটি রাত পরেই ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ প্লেনারির সকালের বৈঠকে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রস্তাব। প্রতিনিধি দলের আসনে অন্যদের সঙ্গে বসে ছিলাম। নিশ্চুপ। কারণ আমার ভেতরের উত্কণ্ঠা আমাকে স্তব্ধ করে রেখেছিল। বুকের মাঝখানটা স্পন্দিত হচ্ছিল তিরতির করে। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সর্বসম্মত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি প্লেনারিতে দেয়া হলো। সারা হলরুমে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম। কোনো দেশই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবে বিরোধিতা করল না। আমাদের যুগপৎ আনন্দিত ও শিহরিত করে তা পাস হয়ে গেল। উত্তেজনায় ড. সা’দত, মান্যবর রাষ্ট্রদূত, ড. হক, প্রফেসর কফিলউদ্দিন ও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। উষ্ণ করমর্দন চলল আমাদের মাঝে। দুই মাস ধরে আনুষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক যে কূটনৈতিক লড়াই চলছিল, যার বিস্তৃতি ঘটেছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ছাড়াও ইউনেস্কো ভবনের করিডর থেকে শুরু করে ক্যাফে, সেমিনার ও প্রদর্শনী কক্ষ, ডকস পিজন হোলস এমনকি স্যুভেনির শপ পর্যন্ত, তার কাঙ্ক্ষিত সমাপ্তিতে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।
প্যারিসে ততদিনে শীত জেঁকে বসেছে। ক্লোক রুমের দিকে সবাই হাঁটছি। রাষ্ট্রদূতকে বললাম, ‘স্যার আমরা এ মুহূর্তে হয়তো ধারণাও করতে পারছি না আজ বাঙালির জন্য কী ইতিহাস তৈরি হলো।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ অনেক বড় ইতিহাস। এ মুহূর্তে বোঝা না গেলেও একদিন অবশ্যই বোঝা যাবে।’ ক্লোক রুম থেকে শীতের কাপড় নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি ইউনেস্কো ভবনের প্রধান ফটকের দিকে। রাষ্ট্রদূত, ড. সা’দত ও ড. হক সামনে। পাশাপাশি। প্রফেসর কফিল ও আমি পেছনে। ওভারকোট পরিহিত সামনের দীর্ঘকায় তিনজনকে মনে হচ্ছিল একটু যেন ভিনদেশী। মনে হচ্ছে ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনজন মানুষ। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী (প্রয়াত) মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭১ সালে। ড. সা’দতও (প্রয়াত) একজন মুক্তিযোদ্ধা। সিএসপি এ কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ছিলেন মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীর একান্ত সচিব। আর মুক্তিযুদ্ধকালে ড. তোজাম্মেল টনি হক (বর্তমানে বার্মিংহামে বসবাসরত) ছিলেন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ রিলিফ অ্যান্ড অ্যাকশন কমিটির উপদেষ্টা ও মুখ্য ভূমিকা পালনকারীদের একজন।
আমার কল্পনায় উঠে আসতে থাকে অনাগত দিন। আগামী দিনের পৃথিবী। পঞ্চাশ, একশ বছর পরের বিশ্ব। আর বিশ্বজুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসব। আমার চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমে। এ রকম আনন্দাশ্রু জমেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। কিশোর গেরিলা আমি সেদিন ছিলাম সিরাজগঞ্জের জন্মভিটা থেকে অনেক দূরে রৌমারীর তাঁবুতে। সেদিনের মতো আবেগ বহুকাল পর আমার হূদয়ের বেলাভূমিতে আবারো উর্মিমালার মতো আছড়ে পড়ে।
আমরা ইউনেস্কো ভবন থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে শীতের মরা রোদে আমাদের ছায়াগুলোকে অস্পষ্ট দেখায়। ড. হক আমাদের মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। যা ছিল আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যের প্রথম উৎসব। আমরা প্রথমে এভিনিউ সাক্সে তার ফ্ল্যাটে যাই। গাড়িতে যেতে যেতে একপশলা বৃষ্টি পাই। শীতে প্যারিসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম নয়। আমরা খোশ চিত্তে চীনা রেস্তোরাঁ ‘ক্যাথে রয়্যাল’-এ লাঞ্চ করি। খাবার জন্য রীতি অনুযায়ী তারা আমাদের দুটো করে কাঠি দেয়। তখন আমার মনে পড়ে পাঠশালা জীবন। পাঠ্যবইয়ে পড়েছি চীনারা দুটো কাঠিতে খায়। কীভাবে খায় তা ছিল এক বিরাট রহস্য।
লাঞ্চের পর আমি দূতাবাসে ফিরি। সেখানেও উৎসবের আমেজ। একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের খবর ঢাকায় প্রেরণের তোড়জোড় শুরু হয়। ঢাকা থেকেও ফোন আসতে থাকে। বিশেষ করে সংবাদপত্র থেকে। তাদের মধ্যে অনেক ঘনিষ্ঠজনও রয়েছেন। কিন্তু আমি মুখ খুলতে পারি না। কারণ আমাকে জানানো হয়েছে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর বাঙালির এ বিশেষ অর্জন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক স্বয়ং প্রেস মিটিংয়ে জানাতে চান। বুকের মধ্যে আনন্দ তোলপাড় করে অথচ তা চাউর করা যায় না।
আমার কল্পনায় উঠে আসতে থাকে অনাগত দিন। আগামী দিনের পৃথিবী। পঞ্চাশ, একশ বছর পরের বিশ্ব। আর বিশ্বজুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসব। আমার চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমে। এ রকম আনন্দাশ্রু জমেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। কিশোর গেরিলা আমি সেদিন ছিলাম সিরাজগঞ্জের জন্মভিটা থেকে অনেক দূরে রৌমারীর তাঁবুতে। সেদিনের মতো আবেগ বহুকাল পর আমার হূদয়ের বেলাভূমিতে আবারো উর্মিমালার মতো আছড়ে পড়ে। গাঢ় হতে থাকে চোখের ধারের অশ্রুকণা। আমি উঠে দাঁড়াই। দূতাবাসে আমার তিনতলার রুমের মধ্যে হাঁটি একটু। দাঁড়াই জানালার পাশে। পাশের বাসার মাপেল ট্রির দিকে চোখ যায়। নভেম্বরের তীব্র শীতে ঝরে পড়েছে তাদের সব পাতা। চোখে তখন অশ্রু আসে। আমি হাতটান করে আড়মোড়া ভাঙি। বুজে আসে চোখের পাতা আর সেই সঙ্গে আমার চোখ দিয়ে আমার নয় গড়িয়ে পড়ে বাঙালি জাতির আনন্দাশ্রু।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত